লেখা ও এপারের ব্যক্তিগত ভাত: মণিদীপা সেন
জানিনা কিসের পাশে বসে থাকি। অদৃশ্য কিছুর পাশে হতবাক হয়ে বসে থাকি। বুঝতে পারি, সচেতনের চেয়ে অবচেতন বেশি সক্ষম হয়ে উঠেছে আমার। জেগে থেকে যা অনুভব করি না সেইসব বা তারও বেশি ফিরে আসে স্বপ্নে। ছোটোকাকা, তার সাথে আমি চাউমিন খাই ভাগ করে। বলি, " এটা ডিম ছাড়া, খেয়ে দ্যাখো "। কাকার ডিম খেলে বমি হত খুব। কাল দুপুরে বাইরের ঘর থেকে ভেতরে এসে বলে, "সরে যা , বিছানায় উঠবো"। ২০১৫-য় ক্যান্সারে মারা গেছে কাকা। কিছুদিন আগে দাদু আমায় অত্যাধুনিক ফোন কিনে দিয়েছে। সেই নিয়ে বাবা আপত্তি করছে, বলছে, " না না এসব কী দরকার, আপনার জমানো টাকা, সুদ কমেছে। ওর পেছনে খরচা করবেন না। ওসব ফোন নিয়ে ও কি করবে?"। দাদু বলছে, " তপন আমায় মানা কোরো না। কী দিতে পেরেছি আর ওকে? কিছুই না... এটুকু থাক"। দাদু আমার লেখাপড়া খুব ভালোবাসতো। আর আমাকে। আমার ২০০৮ এর মাধ্যমিকের ফার্স্ট ডিভিশন দেখে যেতে পারেনি। যারা হারিয়েছে বহুদিন তারা সবাই আসে আমার কাছে। যারা আছে ও থেকেও হারিয়ে গেছে, তারাও আসে ভিন্নভাবে। সব কেমন মিশে যায়। থাকা- না থাকারা যেন পাশাপাশি অবস্থান করে। কেউ কোথাও যায়ই নি যেন! সময় যেন এগোয়নি একটুও বা ঘটনা বদলেছে মাত্র৷ মানুষগুলো সব আছে। শুধু তাদের আসা যাওয়া, দেখা করার ধরণ পাল্টেছে। আমি মানি distance is good when two souls are together. আর এই সোউল বা আত্মা দেহের তোয়াক্কা করে না হয়ত। সে দেহ সচল, জীবিত হোক বা মৃত। আত্মা বয়সের তোয়াক্কাও করে না। আত্মা তার নিজস্ব রাস্তায় যাতায়াত করতে পারে বলে মনে হয় আজকাল। তার ইচ্ছা অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ের, বয়সের দেহ ধারণ করতে পারে। সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যায় বা এগিয়ে। বা এমন সময়কাল রচনা করে দেখায় যা সচেতনে আমরা প্রত্যক্ষ করিইনি হয়তো কোনোদিন। আর সেইজন্যই অনেক জীবিত মানুষের আত্মাকেও আমি সেই মানুষটার পুরানো , ছেড়ে আসা আত্মার প্যাটার্নে দেখি। এটা স্মৃতিচারণ নয়। অন্যকিছু। যেমন কাল দেখি কোনো এক গ্রামের নিচু স্টেশনে বসে আমি আর বাবা। একটা খুব ভিড় ট্রেন এলো। বাবা কোনোমতে উঠে গেল এক বগিতে। আমি পারলাম না। একটা ভিড় বাবাকে গিলে নিলো। ধাক্কাধাক্কিতে খুলে পড়ে গেল বাবার একপাটি জুতো। ট্রেনটা বাবাকে নিয়ে চলে গেল। আমি সেই নিচু প্লাটফর্মে উবু হয়ে বসে আছি ফ্রক পরে আর বাবার জুতো বুকে আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদছি। কেউ কোথাও নেই। বাবা ... নেই... এমন বিভিন্ন স্বপ্ন আসে আমার। তার কিছু বাস্তবের সাথে জড়িত থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ এমন কিছু দেখি যা দেখার সাথে আমার সচেতন জীবিতকালের কোনো যোগ থাকে না। এবং তা অদ্ভূত শিরশিরে কুয়াশাময় কিছু... আমি সেখানেও হতবাক অংশ নিই। আমার এই লেখাটার প্রেক্ষাপটও ঠিক এটাই। আজ এই লেখায় আমি স্বীকার করছি, আমার শাপ আমার কলম রক্ষা করে! কীভাবে, আমি জানিনা।শাস্তি ও মহাজীবন:
সারা গা আঁশে ঢাকা, কালোআঁশ। বক্ররেখা স্ফীত হতে হতে মাথা এক ক্রুর রম্বস। দরজা দিয়ে নিয়ে এসছি তাকে বা সে নিজে এসেছে। বিছানার কিনার অবধি আসতে কাপড় দিয়ে চেপে ধরি তার মাথা। শ্বাসরুদ্ধকর, অদ্ভূত কনট্র্যাকশনে তার মৃত্যু হয়। পরদিন বিকেল পরে গেলে এক মানবী আসে আমার কাছে। তার দেহ ছিপছিপে, তার কোমরে ঢেউ, উচ্চতা মাঝারী। চুলের গোছার মুখ চিরতরে বন্ধ করা হয়েছে; জটা। সারা দেহে একপ্রকার ভস্ম ছড়িয়ে আছে, বসন সম্পূর্ণ কালো ও জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। তার মুখের দিকে চাই। তার বাম চোখটি বোজা। অপর চোখ গাঢ় ও চকচকে। ঠিকরে ওঠা তার দৃষ্টি। সে বলল, " ওকে মারলি কেন?" আমি বলি, " ভয় পেয়ে"। " ক্ষতি করেছিল?" " না" "তবে মারলি কেন?" "ভয় পেয়ে, যদি অনিষ্ট করে!" " ভুল করেছিস। বড় ভুল"
সে চলে যায়। আবার পরের দিন আসে। একই বেশ, একই কথা। যত দিন যায় তার এক চোখ অপেক্ষাকৃত চকচকে হয়ে ওঠে। কিছুদিনপর আমি ভয় পেতে থাকি সেই জ্যোতি, সেই অজানা চোখের আলোকে। অকথ্য ভয়। তাকে জিজ্ঞাসা করি " কী করলে মুক্তি দেবে তুমি?" " তোর মুক্তি আমার থেকে নয়, নিজের থেকে দরকার"। "ভুল করে ফেলেছি। অত্যন্ত ভুল। মানছি"। " এখন কিছু করার নেই।" "তাহলে? " " আমি রোজ আসব। তোর ভুল মনে করাতে। একই কথার মধ্যে দিয়ে তুই রোজ যাবি। একই খুনের গল্প রোজ মনে করবি। ক্রমাগত তোর খেদ বাড়বে। ক্ষমার অর্থ বুঝবি। অনুতাপের দহন বুঝবি"। " মুক্তি নেই এর থেকে?" " মুক্তির উপায়, প্রতিকারের রাস্তা আগে থেকে জানলে শাস্তির প্রাবল্য ফিকে হয়ে যায়। তবে যেদিন এই চক্র শুরুর বিন্দুতে মিলবে, আমি আর আসবনা। সেদিন সন্ধে নামলে এই বাড়ির সবচেয়ে উচ্চস্থানে উঠবি আর নিজের দুই হাতের নখ পরিস্কার করে কেটে ফেলবি। জন্মের ভেতর একজন্ম, তোর খুনিজন্ম, সেদিন শেষ হবে"। সে চলে যায়। দিনের পর দিন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলে। সে আসে। আমি পুড়ে যাই তার আসার ভয়ে। কেন করেছিলাম, কেন? সময়ের সাথে, রোষ বয়ে চলে খেদের দিকে। সেই কালো আঁশের ওপর নেমে যায় জল। অপার বৃষ্টি। হাঁটুমুড়ে বসি পড়ন্ত বিকেলের পায়ে। চিলছাদের দিকে তাকাই। চোখের সামনে মেলে ধরি নিজের দুই হাত।
2 comments:
দু'টো গদ্যই আমার ভালো লেগেছে... যদিও দু'টো নয়, ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় এখানে আসলে একটাই গদ্য... 💖
লেখো... আরও পড়ি।
মতামত এতটাও প্রাধান্য পায় না। আর... সবক্ষেত্রে মতামত জানাতেও নেই।
--- শুভঙ্কর
Post a Comment