মোদের ‘মধ্যরাতের দোজখযাপন’: রাহেবুল

আমরা 'প্রথম কাব্যির পরশ' বিভাগে উপস্থাপন করি কবির প্রথম কাব্যকে, ‘তারুণ্যে’র কবির প্রথম কাব্যকে। এ দফার উদযাপনে রইলেন কবি ওয়াহিদার হোসেন। আলোচনায় অধম রাহেবুল।
মোদের ‘মধ্যরাতের দোজখযাপন’: রাহেবুল
দশক বিচারে শূন্য দশকের কবি ওয়াহিদার হোসেনের প্রথম কাব্য ‘মধ্যরাতের দোজখযাপন’। এতে মোটে কুড়িখানা কবিতা। সবচেয়ে বড়ো কবিতাটি সাত লাইনের। সবচেয়ে ছোট কবিতাটি দুই লাইনের। বলাবাহুল্য কবি অতিকথনে বিশ্বাসী নন। তবে এমন নয় যে লেখাগুলি আকারে-আয়তনে ছোট বলে তা রসাস্বাদনে বাধা হবে। যেমন বইটির সবচেয়ে ছোট কবিতাটি এবং যেটিকে বইটির নাম কবিতা বলা যেতে পারে ভাবের বিচারে—কবিতাটির নাম ‘দাম্পত্য’। কবিতাটি পড়া যাক—

“মধ্যরাতের দোজখযাপন

পাশবালিশের সীমানায়”

মাত্র দু’লাইন কিন্তু কত কিছু বলে যাচ্ছে এ কবিতা, নিদ্রাহীন রাতের দুপুরগুলি আমাদের মনে পড়বে। ধরুন অল্পবয়সী কবি কী কবিনী! বা কবি নয় কিন্তু যৌবনের দাবদাহে (প্রেম, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি মিলিয়ে গুবলেট) ভীষণ জ্বরাক্রান্ত, এ লেখা তাদের প্রিয় হবে, কেবল চাই খানিক ভাষাবোধ (জিনিসটা বিতর্কিত এবং জটিল যদিও। কার যে ও আছে আর কার নেই সে বিচার খোজা খোদা জানেন?)। এ কবি আটপৌড়ে উপকরণ নিয়েই তার কবিতা তৈরি করেন। শব্দের ধ্বনিমাত্রিকতায় কবিতাকে করেন সোমত্থ। দেশীয় শ্লাং বা দেশীয় অব্যবহৃত শব্দ নিয়ে কবির ততটা কারবার নয়, কবি তৎসম বহুল ভাষা ব্যবহারেও বিশেষ আগ্রহী নন বরং গতানুগতিক ভাষার বিভিন্ন সুতোগুলো ধরে খেলতে ভালোবাসেন। মধ্যবিত্ত মানসিকতার টানাপোড়েন, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভাঙাগড়া, উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক পরিবেশের কিছু উপকরণ-উপাদানকে আশ্রয় করে কবি তার ভাবকে জারিত করেন। কবির মন-মননে, ভাষায় চিরায়ত সুফিবাদের ছোঁয়াচ। ভাষার ক্ষেত্রে কবির অবশ্য আরেকটা ঝোঁক চোখে পড়বে সেটা হলো পরিচিত হিন্দি-উর্দু কিছু শব্দের কাব্যিক ব্যবহার। যদিও এমন নয় যে এই শব্দগুলি গ্রামবাংলার প্রান্তীয় মুসলমান সমাজ থেকে উঠে আসা শব্দ।
আরেকখানা কবিতা পড়া যাক। কবিতার নাম ‘পরিন্দা’।

“কাঁদে পরিন্দা ছুটির দিনসমূহ গলায় ফাঁস

আটকে রিমি-দি, বাতিসকল। পায়চারি

দুপুরবেলায় অসুখ, ভালোবাসা কেমন

গড়িয়ে আসে মরণের পরপারে”

বলবার মধ্যে বিপুল পরীক্ষানিরীক্ষা নাই-বা থাকলো কিন্তু এই বলা ততখানিও কি গতানুগতিক? আমাদের তা মনে হয়না। বাক্য-গঠনে নতুনত্ব আছে। এই নতুনত্ব সারা বইয়েই। তবে এখানে একটা প্রশ্ন: এভাবে হঠাৎ এক কবির ব্যক্তিনাম কবিতাটিতে এল কেন? এই ধরনের নামোল্লেখ সহ বা নিজের নামের উল্লেখ সহ কবিতা লিখবার চল অতীতে কৃত্তিবাসীদের মধ্যে ছিল বা হাংরিদের ছিল, কোনো কোনো সময় তা অতি ব্যবহারে জীর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছিল। এ কি উপলব্ধিজাত? এ কি অনিবার্য ছিল? তাহলে আমাদের কিছু বলবার নেই। এরকমের আরেকটি কবিতা এ বইয়ের ‘দূরত্ব’। এখানে অবশ্য ব্যক্তিনাম নেই, আসে স্থাননাম— কবির প্রেমাভিসার।
আরেকটি কবিতা ‘অ্যাসাইলাম’। কবিদের প্রিয় অ্যাসাইলাম!

“অ্যাসাইলাম সাজোয়া হয়ে ঘিরে রাখে জবরদস্ত অসুখ

কেন তুমি বারবার ফিরে আসো? কেন? হাতের তালুতে

লিখি বৃদ্ধাশ্রম       প্রেম-এর দু-পশলা বৃষ্টি...”

পূর্বের সেই ‘দাম্পত্য’ কবিতাটির সঙ্গে এর মিল। “প্রেম-এর দু-পশলা বৃষ্টি” টুকু কি প্রক্ষিপ্ত? তা হোক বা নাহোক এই অংশটুকু তুলনামূলক জোলো কিন্তু বাকি অংশেই এ লেখাটা কিস্তিমাত করে যায়। এ লেখা ভোলবার নয়। “কেন তুমি বারবার ফিরে আসো” আর “হাতের তালুতে লিখি বৃদ্ধাশ্রম” এ দুয়ের মিশ্রণ ভীষণই কাব্যিক, মর্মভেদী।
আবার কিছু কবিতায় কবি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, শব্দ থেকে শব্দান্তরে যেতে বাক্যবিন্যাস ধারাবাহিক রাখেননি বরং জাম্প মেরে অন্যদেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছেন। যেমন ‘পাতিকাকের বাচ্চা’, ‘দশ আঙুলে’র মতন কবিতাগুলি।
তবে আমাদের মনেহয় কবির সিদ্ধি স্বল্পায়তনের কবিতাগুলিতেই। এগুলির বাঁধন পাঠককেও টেনে রাখবে। যদিও এগুলি ঠিক কবি শ্যামল সিংহ খ্যাত ‘সংহত কবিতা’র মতন নয়। কবির আরও কয়েকটি কবিতা পড়া যাক—

“কলজেয় আগুন কেন জ্বলছে হরদম। কাকপক্ষী উড়ে যাচ্ছে কেন? আমার

দু-হাত ভরে উঠছে প্রার্থনায়। আমার নিজের দোষে যেন প্রিয়তম কষ্ট না

পায়”। [প্রিয়জন কষ্ট না পায়]

বা

 “রোদসাইকেল এলে

 জমে ওঠে ক্লাসরুম

 হাতে হাত খাতাবদল” [বদল]

বা
“দমবন্ধ হয়ে যায় ভালোবাসার ভালোলাগার শেষে। আজ
কাল পরশু করে কাটিয়ে দিচ্ছি সন্ধ্যা। আমার আপাদমস্তক
জ্বর আসে। কঠিন জ্বর যেন
কেউ জ্বালিয়ে দিচ্ছে দিয়া। জ্বালিয়ে দিচ্ছে সমগ্র শরীর...” [দিয়া]

 

এই প্রেমপূর্ণ লেখাগুলিই মনেহয় এ বইয়ের সবচেয়ে ভালো কবিতা।

 

উত্তম কুমার তালুকদারের আঁকা চিত্র খুব একটা স্পষ্ট ফোটেনি প্রচ্ছদে।

 

আলোচিত বই- ‘মধ্যরাতের দোজখযাপন’

 কবি- ওয়াহিদার হোসেন

 প্রচ্ছদ- উত্তম কুমার তালুকদার

 প্রকাশক- দৌড়, কলকাতা

 যোগাযোগ- ৯৪৭৭২৫১৪৪৯

 আলোচক- রাহেবুল


কবি-পরিচিতি: ওয়াহিদার হোসেনের প্রথম কাব্য ‘মধ্যরাতের দোজখযাপন’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক—দৌড়। কবির জন্ম ১৯৮৬ সালে আলিপুরদুয়ার জেলার (তৎকালীন জলপাইগুড়ি) এক প্রান্তিক গ্রাম দক্ষিণ খয়েরবাড়ি রাঙ্গালিবাজনায়। সিরিয়াস লেখালেখি শুরু ২০০৫ সাল থেকে। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘এখন’ বাংলা কবিতার কাগজে। নিয়মিত লেখেন এখন, কবিতা ক্যাম্পাস, কবিতা পাক্ষিক, কবিসম্মেলন, ভিন্নমুখ, ইবলিশ, দৌড় এবং বিভিন্ন ওয়েবজিনে। ২০২০ তে কবির দ্বিতীয় কবিতার বই ‘পরিন্দা’ প্রকাশের কথা চলছে।

No comments:

ফেসবুক কমেন্ট

অধিক পঠিত লেখাগুলি