পৌলমী গুহর গদ্য: পৃথিবী ও জ্ঞানদায়িনী হেতু

চিত্র: বরিস মাইসেভিক


পৃথিবী ও জ্ঞানদায়িনী হেতু: পৌলমী গুহ
অতঃপর একদিন আমার আত্মহত্যাকামী মাথাটি ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। গন্তব্যবিষয়ক চিন্তাভাবনা কোনোওকালেই ছিলো না। সুতরাং এখানে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা নেই। দুপুরের কলকাতা অস্বাভাবিক ব্যস্ততা নিয়েও কীভাবে নিস্তব্ধ থাকে তা শিখিয়েছে; চরম ও পরম বিশ্বাসে তাই বেরিয়ে পড়লো। কিছু মন্থর কিছু দ্রুত দৃশ্যাবলী পেরিয়ে একটি আধা-কলকাতা আধা কলকাতা বিচ্যুত স্টেশনের ওভারব্রিজে পৌঁছোনো গেল। যেহেতু দুপুর, অতএব ছন্নছাড়া প্রেমবিলাসী যুগল, জীবনযুদ্ধে মগ্ন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষজন ও ক'টি দার্শনিক পাগল ও ভাববিহ্বল সারমেয়, এবং আত্মহত্যাকামী আমার মাথা— এই ক'জন স্টেশনের ভাগীদার। ওভারব্রিজ থেকে রেললাইনের দাম্পত্য দেখতে দেখতে আমার সুবিধার লাগে না। বিশেষত, এই দিবানিদ্রাকালে, চিরাচরিত বিচ্ছেদ অভ্যস্ত দম্পতিকে ব্যতিব্যস্ত করতে মাথা চাইলো না। তাই আমি আমার আত্মহত্যাকামী মাথাটি সহ ওভারব্রিজের ফ্রিজ শট থেকে বেহালাবাদকের মতো স্থিরতায় ক্রমে সরে সরে যাই… দ্বিতীয় চিন্তায় কলকাতার পেটের ভেতর ঢুকে যাই। ভূতলে সারমেয় নাই। নাই কোনোও দাবদাহের দীর্ঘশ্বাস। হেথায় স্বর্গ স্বর্গ মনোভাবে লোকে চেপে চলে, চুপে বলে। দুপুরের কিছু মাহাত্ম্য বিকীর্ণ করা ঝিমধরা মহীয়সী প্রৌঢ়ারা তাঁহাদের উত্তুঙ্গ রোদচশমা ভুলে যায়। আমার আত্মহত্যাকামী মাথাটি এমন এক প্রৌঢ়ার পাশে বসে। নাকে আসে পুরোনো সন্দেশ, বেলফুল আর সস্তার ধূপের গন্ধ। কিছুই মনে পড়ায় না। কোনোও দেশ, কোনোও বিরহ কিছুই নয়। হঠাৎ টের পাই এই কৃত্রিম পরিবেশে মৃত্যু একটি বিরক্তির মোহময় খোলস ছাড়া কিছুই নয়। অতএব আমি বেলফুল ও রোদচশমা পেছনে ফেলে গর্ভ থেকে ফিরতে শুরু করলাম। ওপরে তখন ক্রিমরঙা বিকেল। পরপর দু'টি ব্যর্থ প্রচেষ্টায় আত্মহত্যাকামী মাথাটি ঈষৎ ধাঁধাঁখোর। বিনা প্রচেষ্টায় মৃত্যু সংঘটিত হয় না, এই সত্যের মুখোমুখি হয়ে সে দিক ভুলিতেছে। আমি সুতরাং গঙ্গার ঘাটপ্রতি ধাবমান হই। এস্থানে জরা হোক বা কৈশোর, কাহার সহিত কাহারো বিবাদ নাই। পা ফেলে হেঁটে একটি মনোমত গাছতলা খুঁজি। পাই না। সর্বত্র যুগল মিলনের দৃশ্য রচিত হইয়াছে। তীব্র বিরক্তি আত্মহত্যার ভাবটুকু পেঁয়াজের খোসার মতো উড়াইয়া দিলো। আরাম পাইলাম। জীবন পরিবর্তনশীল ভাবিয়া এই পৃথিবীর অমৃত ও গরলে নিমজ্জমান হইলাম। মাথা ঠান্ডা হতে ঠিক ক'খানি ভোঁ লাগে জানি না। এই গুরুচন্ডালী ভাবনাসমূহ কেটে যাচ্ছে। কে যেন পুরোনো হিন্দি ফিল্মের গান চালিয়েছে। মস্তিষ্কের অফুরান জানালা খুললে গাদা গাদা বাস্তব আছড়ে পড়ে। আত্মহত্যা আপাতত স্থগিত। সামনে গঙ্গা, বিকেলের ঢেউ এযাবৎ কতো নীরব আত্মহননের ইচ্ছা সঞ্চয়ে রাখে কে না জানে! আরো ভালো করে বললে, সামনে পৃথিবী। আকাশ যদিও নীল নয়, ঈষৎ বেগুনি, ঈষৎ গোলাপি, ঈষৎ লাজুক কমলা। সাঁতার জানি না মা, সাঁতরে জীবননদী পার হইবো ক্যামনে? এপারে ছোলা-মাখা, লাল চা, হি হি হাসির আশীর্বাদে অর্ধনারীশ্বরের দল, "অ্যাই দিদি রাজপুত্তুর বর হবে, দে দিকি দশটা টাকা!" মনে পড়ে তড়িঘড়ি রাজপুত্তুর গাল ফুলিয়ে কে জানে কোন আদিমতম ক্ষুব্ধ বাসনায় কোথায় চলে গেছে। ফেরত আনি। তারপর ট্রেনে চেপে...ঘোড়া ঘোড়া ঘাস ঘাস… জীবন সুন্দর। ঈষৎ বেগুনি, ঈষৎ গোলাপি, লাজুক কমলা। বড়ো সুন্দর।

No comments:

ফেসবুক কমেন্ট

অধিক পঠিত লেখাগুলি