সিন্ধু সোমের গল্প: তারায় তারায় কাজলনাভি


চিত্র: পাওয়েল চেরয়েনসকি

তারায় তারায় কাজলনাভি: সিন্ধু সোম
ক্রমশ কাঁচের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা স্থির নক্সাকে কতগুলো সরল রেখায় বদলে ফেলে মদের গ্লাসটা টুং টাং করে জলতরঙ্গের প্রতিটা কম্পন আগাপাশতলা গায়ে জড়িয়ে গড়াতে গড়াতে ঠিক যে জায়গায় গিয়ে থামল সেখানে একটা বড় নুড়ির গায়ে অজয়ের ছেড়ে যাওয়া ইতস্তত ফেনা এসে লাগে মাঝে মধ্যেই। কিছুক্ষণ লেগে থাকে। আঁকড়ে থাকার পথে যে শুধু মাত্র পায়ের দাগই পড়ে থাকে তা বোধহয় এই নবাজাতক ফেনার ধারণার বাইরে। ধীরে ধীরে পড়ন্ত বেলার আলোয় কপিশ বুদবুদ ছাপটুকু থেকে যায়। আবার একরাশ স্রোতের ফেনা ধুয়ে মুছে দিয়ে যায় মেঝে। স্রোতের আওতার খানিকটা বাইরে যেখানে শুধু হালকা ঢেউ ছাড়া কিছুই পৌঁছয় না, হাঁটু ডোবা জল ঘেরা এমন একটা চরের কিনারায় বসে কাজল দেখছিল। ঠোঁটের এক পাশে সিগারেটটার পুড়ে যাওয়া শরীর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে বাতাসে হারিয়ে যাওয়ার আগে তার মুখে চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও একটা অস্বচ্ছ ছায়া এঁকে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। অঘ্রাণের শীতকাতুরে আকাশের এখানে ওখানে খোঁচা খোঁচা কয়েকদিনের বৃষ্টি না হওয়া মেঘ জমে রয়েছে। এসময় অজয়ে বেশি জল থাকে না। জলের স্তর নেমে গেলে ধাপে ধাপে অগভীর এক পাতালপুরীর ঢেকে রাখার ঐতিহ্য নিয়ে তার পাথুরে বুক বেরিয়ে পড়ে। অজান্তেই কাজলের হাল্কা গরম জামাটার বোতাম খোলা বুকে হাত ঢুকে যায়। এই মিঠা মিঠা প্রথম শীতের চুমু বয়ে আনা আমেজে ঘোর লাগে খুব। উদাস দুপুরের শেষটুকু কোনো সাদাকালো গল্প দেখার জন্যে স্মৃতির পায়ে মাথা কুটে কুটে মরে। হাত নিজের খর স্তনবৃন্তে অথবা জাঙ্গিয়ার ভিতর ঢুকিয়ে রাখলে একধরনের মৃদু স্তিমিত উষ্ণ অনুভূতি হয় ও কাজলের আরাম লাগে। মরে আসা দুপুরের ক্রমাগত অনুনয় বিনয় বেলাটাকে এক রেখে দিন মাস বছর ঘড়ির চাকা অনেকটা পিছিয়ে দিতে থাকে হু হু করে।
সেই পুনরাবর্তিত সময়ের গর্ভের ছোঁয়া পেয়ে অজয়ের স্রোত দমকে দমকে বেড়ে ওঠে এবং চড়া বলে তখন আর কিছু থাকে না। কাজল দেখে সে একটা প্রায় ডুবে যাওয়া পলাশ ঝোপের আড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশ জলের সীমারেখা আবছা। কম বয়সের চশমা আলগোছে খসে যাওয়ার এক শিরদাঁড়া শিরশিরে অসহায়তার অনুভূতি নিয়ে সেইখানে প্রায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থাকে কাজল। ঘোর বর্ষার কয়েক পোচ ঘোর, কদিনের অবিরত বর্ষণে একটু ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। অজয়ের জলের অজস্র ঘূর্ণি। মাঝে মধ্যে তার ওপরে গোল হয়ে ঘুরতে থাকা হাওয়া দলছুট হয়ে আছড়ে পড়ে তীরের ওপর। দুই পাড়ের অযত্ন কুড়িয়ে বাড়িয়ে বেখাপ্পা রকম বেড়ে যাওয়া খেজুর আর নারিকেল গাছে তার সোঁ সোঁ বাজনা শোনা যায়। পাড়ের জোলো জমিনে এক বুক আগাছার ফাঁক ফোঁকর গলে বেরিয়ে আসে লক্ষ লক্ষ ব্যাঙের যৌনশব্দ। আর সেই প্রতি মুহূর্তে ক্ষয়ে যাওয়া পাড়ের চিবুক ঘেঁষে অবিশ্রান্ত স্রোতে পেরিয়ে যায় খড়কুটো, পাখির বাসা, মরা চোখ উলটানো জীব দেহ। তাতে পচা গন্ধ ছাড়ে খুব! দু একখানি মোটা গাছও ভেসে আসে মাঝে মধ্যে। উপরের দিকে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। দেহাতি প্রদেশের গড়িয়ে আসা জল চলার পথে তার পাথেয় জোগাড় করে এনেছে বোধ হয় একটি একটি করে। এত তার বৈচিত্র। এই সব বিনা শুল্কের যাত্রীদের ভিড়ের মাঝে পাহাড়ের উত্তুঙ্গ চ্যাটালো পাথর কয়েকখানা এখনও মাথা উঁচু করে রয়ে গিয়েছে পাড়ের কাছাকাছি। কয়েকটা কাক এসে মাঝে মধ্যে সেখানে বসে। ছিটকে আসা পোকা, ঝোপে ঝাড়ে আটকে থাকা ছোট খাটো উৎসহীন জীবদেহের পচা মাংস খায়। পাথরেই ঠোঁট মোছে। আবার উড়ে যায়। চারিদিকে প্রবল নিঃসঙ্গ এক নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্ব। এক প্রবল শূন্যতা। একটা লোক নাই কোথাও। বহুদূর অবধি যদিও চোখ চলে না, তার আগেই দৃষ্টি বেঁকেচুরে গুলিয়ে যায়। এমন একটা ঘোলা ছাতের তলায় বহু পুরোনো বর্ষার কোন একটা দিন মাপতে গিয়ে কাজল হঠাৎ টের পায় তার পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
তীরবেগে কাজলকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় চারটি ছেলে। তাদের বয়েস চৌদ্দো পনেরোর কাছাকাছি। পরনে একফালি জাঙ্গিয়া তাদের বাড়ির পরিচয়, সম্ভ্রান্ত অথবা লোকায়ত পার্থক্য বোঝাতে নিতান্ত অনিচ্ছুক। কাজল চিনতে পারে। আবদুল, চন্দন, শান্তনু এবং তার নিজের মূর্ত ছেলেবেলা। শেষ ছেলেটির হাত ফট করে ধরে ফেলতে চায় কাজল। শাসন করে ধমকে দিতে মন সরে। কিন্তু ধরা আর যায় কই! ছেলেগুলো পাড় ধরে ধরে খানিকটা এগিয়ে যায়। পাড় থেকে ক্রমশ স্রোতের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা ঝুলন্ত পাথরের ওপরে আবদুল একটা পা রেখে চাপ দিয়ে দিয়ে দেখে। “কীরে ওঠা যাবে?” শান্তনুর অধৈর্য চোখ কুঁচকে এতটুকু হয়ে আসে। চন্দন বাধা দেয়। “কী বলছিস কি! এই রকম স্রোত! ঝাঁপ দেয়া যাবে না বাঁড়া! একধারে নেমে ধীরে ধীরে একটু স্নান করে নেই বরং, চ!” শান্তনুর ব্যাপারটা মনঃপূত হয় না! এতদূর এসে শেষে নদীতে ঝাঁপ দেয়া যাবে না! ও দোনোমোনো করতে থাকে। পুরোনো কাজল কম কথা বলে। আশপাশ দেখে বেশি। হঠাৎ বজ্রাঘাত! মাথায় কী যে বুদ্ধি চাপে, ওদের বাগবিতণ্ডায় ক্রমে অতিষ্ট হয়ে ওঠা পুরোনো কাজল কেউ কিছু বোঝার আগেই এক দৌড়ে আবদুলের চওড়া ছাতি পেরিয়ে যায়। নদীতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ ওঠে। স্রোতে কিছু পড়লে জলের পরিচিত ফিরিয়ে দেয়া শব্দেরা পথ হারিয়ে ফেলে। পুরোনো কাজলের পা দুটো জলে একটু ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্রোত যেন পা দুখানা বেঁধে ফেলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে। মুহূর্তে বেশ কয়েক হাত স্রোতের সঙ্গে এগিয়ে যায় ও। এরপর কাজল আর দেখে না। দেখতে চায় না। ও জানে ওকে বাঁচাতে এরপর ঝাঁপ দেবে আবদুল। আর ঠিক সেইসময় একটা ঝুলন্ত পাকুড়ের ডালে আটকে গিয়ে বেঁচে যাবে তার পুরোনো জলছবি। ভিজে রঙগুলো একটু অবিন্ন্যস্ত মাত্র। এলোমেলো। বিক্ষিপ্ত। দিনের শেষে সে একমাত্র আবদুলই যে তাদের সঙ্গে সেদিন ঘরে ফেরে নাই। পরদিন দূর্গাপুর ব্যারেজের কাছে তার নিথর সাদা ফ্যাকাসে লাশটা পাওয়া গিয়েছিল। এই সেই নদীর বর্ষা। অথচ এখন হেমন্ত কাল। বর্ষার শুকিয়ে আসা দুধে এখন চামড়া আর খানিকটা শুষ্ক বিলাপ পড়ে থাকে। তাই শীত মন উদাসী। এই ক্রম ঘনায়মান সন্ধের আকাশের নীচে মাটিরই কোনো কোণে হয়তো কাবেরী আজ চুল ধুয়ে এসেছে। চিরুণির এক একটা আঁচড়ে তার চুল থেকে খসে পড়ছে বঞ্চনা! সেই বঞ্চনাও বিকিয়ে যাচ্ছে রোজ। না গেলেও যাবে একদিন। কাজল জানে। হেমন্তের এক দুপুরে এই অজয়ের চর থেকেই কাবেরী অপরূপ দুটো ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল। পরী বলো পরী, স্বপ্ন বলো স্বপ্ন, কিন্তু ঠিক তার পরের মুহূর্তে ও যে আর হাঁটছিল না— একথা টুকু সত্যি। ক্রমাগত তার নাড়তে থাকা ডানা ধীরে ধীরে দিন গেলে দিগন্তের বুকে আরো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে এসেছিল। কাজলের দৃষ্টির দূরতম সীমানাটিতে সে মিলিয়ে যাবার আগেই তার ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ মিলিয়ে গিয়েছিল। কাবেরী কিছু বলে যায় নাই। হঠাৎ করে চলে গিয়েছিল। তবু কাজলের কেন জানি না মনে হয় এমনটাই হওয়ার ছিল! আবদুলই কি বলে গিয়েছিল? এই পর্যন্ত মনে পড়লে কাজলের বড্ড মন কেমন করে। পাতলা শীতের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই একটা পাতলা ভয় তার ভেতরে উঁকি ঝুঁকি দেয়। আবদুল কী নিজে গিয়েছিল? নাকি নিশির ডাকে তাকে একটু একটু করে টেনে নিয়ে এসেছিল কাজল? আবদুলের মৃত্যুর ভার কী কাজলকেও আষ্টে পৃষ্টে জড়ায় নাই? নাহ্‌! তবু আবদুলের বলে যাওয়াটা উচিত ছিল! না বলে কয়ে যাওয়াটা তার একদমই ঠিক হয় নাই। নদীর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে এরপর আকাশ খুঁজতে চাইলে এর প্রতি ঢেউয়ে ঢেউয়ে এক প্রাচীন মৃত বন্ধুর অথবা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া চির অর্বাচীন এবং নিরুদ্দিষ্ট প্রাক্তনীর মুখ ওঠে আর নামে, দোলে আর সরে। আজ এতদূর এসে কাজলের মনে হয় বহমানতায় লাশ বা স্মৃতি-এর কোনোটাই স্থির ভাবে ভাসতে পারে না ………
“কীরে? তুই এখানে! দেখ তো! আমি বোতলটা নিয়ে কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। তাও তো সবাইকে লুকিয়ে আসতে হল। শ্মশানে তো ভিড় লেগে গেছে আজ পুরো! সে যদি দেখতিস! মানু, মানুর বাবা, চৌধুরী কাকু, ফুলি দি……” বলার উৎসাহে শান্তনুর মুখটা লাল হয়ে ওঠে। কাজল ওর হাত থেকে মদের বোতলটা নিয়ে বালিতে রাখে। কে এসেছে, কে গেল- তাতে আর উৎসাহ লাগে না। ও গ্লাস পাতে। নতুন গ্লাস। পড়ে যাওয়াটা পড়েই থাকে। কাত হয়ে যাওয়া মূর্তিমান এক অতীত। সেই খোলা আকাশের নীচে সূর্যহীন সূর্যালোক কাজলের গ্লাসে বোতলের সস্তা হুইস্কিতে জমাট বেঁধে গাঢ় সন্ধে হয়ে পড়ে। দিনের শেষে কয়েকটা পিছিয়ে পড়া পাখি হু হু করে অন্যমুখী হাওয়া কেটে ছুটে যায় বাসার দিকে। বাসার কথা মনে হলে কাজলের আজকাল আর মা বাবার কথা মনে পড়ে না! কাবেরী বা মণীষার কথা মনে পড়ে না! কেমন অদ্ভুত বিষয়! যাদেরকে কেন্দ্রে রেখে সারাটা জীবন একরকম কেটে গেল আজ বাসার কথা ভাবলে তাদের ছোঁয়াটা পর্যন্ত পাওয়া যায় না। “আমার আর বাসা বলতে বাসার লোকেদের কথা মনে পড়ে না, জানিস!” শান্তনু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এরকম একটা জবাবের জন্য সে বা তার হাতের হুইস্কি কেউই তৈরী ছিল না! চল্কে যাওয়া মদের শেষ চিহ্ন টুকু পাক্কা নেশাড়ুর মতো শুষে নেয় প্রকৃতি! কাজল খেয়াল করে না। বলে চলে, “অথচ ভাব, আমি কি তোকেই কম বার বলেছি, যে ঘরের মানুষদের ছাড়া ঘরের কোনো অস্তিত্ব নাই!” কেন যে সেটা এত আক্ষেপের বিষয় সেটার শান্তনু কিছুতেই নাগাল পায় না। কাজল বলে, “আজকাল ঘর বলতে শুধুই শূন্যতা বুঝি। খালি চেয়ার, খালি টেবিল, খালি বিছানা……ভালো করে খেয়াল করে দেখ এই খালির মধ্যেও কতটা পূর্ণতা রয়েছে! যা নাই, তাদের না থাকাটা যে এভাবে একটা শব্দের সমস্ত সম্ভাব্যতা ছাপিয়ে তাকে ভরে রাখতে পারে, সেটা কি তখন জানতাম?” শান্তনু এতক্ষণে খেই পায়, “না থাকাটাও আদতে থাকাই তবে এক ধরনের! তাই ভাবছিস তো?” কাজল এক চুমুকে মালটা শেষ করে বলে, “কিছুই ভাবি না! অন্তত ভাবতে চাইছি না! কিন্তু ভাবনা কি থামানো যায়? আমাদের স্কুল কম্পাউণ্ডের ভেতরে একটা তেঁতুল গাছ ছিল মনে আছে তোর? সবাই পেচ্ছাপ করত যেখানে? একদিন বর্ষায় অত বড় গাছটা বাজ পড়ে ঝলসে গেল। ধীরে ধীরে উই ধরল, মাটিই হয়ে গেল! অত বড় গাছটাও! বহুদিন পরে সরস্বতী পূজোয় আমি স্কুলে গিয়েছিলাম জানিস! এখন মাঠের উল্টোদিকে নতুন ইউরিনাল হয়েছে। আর ও দিকে, মানে গাছটার দিকটা একদম ফাঁকা। গাছটার চেহারা টেহারা বা পরীক্ষা শেষে তেঁতুল কুড়োনোই বল অথবা সেই পেচ্ছাপের গাঢ় গন্ধ, লুকিয়ে মাস্টারবেট করা- সেসব স্পষ্ট স্মৃতিরা কিছুই সে মুহূর্তে আমার মনে আসে নাই! অথচ সেই যে বিরাট একটা কিছু না থাকা, এই অনুভূতিটা বহুদিন মনের ভেতর রয়ে গিয়েছিল। ওটা যে ছিল একদিন, সেটা যেন কিছু না! কিন্তু ওটা যে নাই আজ, শিকড় সমেত এই না থাকাটার শিরশিরে একটা ভয়, না থাকাটার বিরাট ফোঁকরটা নিজের থাকটাই যেন কথা বলতে চাইছে! অপলক তাকিয়ে থাকা একটা বিরাট চোখ, যার পলক চোখের চামড়া সমেত পুড়ে গিয়েছে—সে আমাকে প্রশ্ন করছে—খোঁচায় খোঁচায় আমার জিভের ডগা অবধি রক্ত এসে গিয়েছে—কেন এলে? এই এতদিন পর—সব চুকে বুকে যাওয়ার পরে শুধু অনুষ্ঠান পড়ে থাকে—তুমি কি অনুষ্ঠিত খোদ? নাকি তুমি অনুষ্ঠানের একটি চরিত্র? যে নিজেও জানে না সে কেন অনুষ্ঠানে এসে বসেছে! যা নাই তাই আদতে সব থেকে বেশি আছে। কোনো কিছুই নাই হয় না। নাই বড় কমজোর পরজীবী…প্রশ্নের উপর চেপে বসা প্রশ্নেরা মাথার মধ্যে পাক দিয়ে শিরা ছিঁড়ে দিতে চায়, জানিস! পালিয়ে আসি উর্ধ্বশ্বাসে। সেই অনুভূতি বুকের মধ্যে এমন ছাপ ফেলল, যে আমি প্রায় পনেরো বছর সেই অনুভূতি বুকে নিয়ে ঘুরে ছিলাম। অথচ তার সঙ্গে কোনো স্মৃতি জড়িয়ে ছিল না! অনেকে বলেন, বলেন মানে কী, আমি নিজেও দেখেছি এককালে যে শুধু অনুভূতির কোনো স্মৃতি থাকে না! তার জন্য সেই অনুভূতি কোনো ঘটনার স্মৃতির সঙ্গে লতায় পাতায় জড়িয়ে থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। এই অনুভূতিরও কোনো স্মৃতি ছিল না। শুধু না থাকাটাই সমস্তটা জুড়ে ছিল। আদতে শূন্যতা একটি নিরেট বস্তু। অনুভূতিটা সব সময় বুকের ভেতর চাপ হয়ে থাকত। তারপর তো…যিক গে…আমি যেটা বলতে চাইছি, মানে সেই অনুভূতির পিছনটা বেবাক ফাঁকা…ভূতের নেত্য…সেখানে কোনো ঘটনার স্মৃতি নাই! বুঝতে পারলি? দেখ, দেখ শালা! কিছু না থাকাটা ভেবেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে কেমন!”
শান্তনু পুরোটা বোঝে না। তবু যেন বোঝে! তখন অর্জুন গাছের ছায়ায় এক কাঠি দুই কাঠি করে না ওঠা পরোক্ষ চাঁদ পড়ে থাকে। আকাশের সানকি চেঁছে পুঁছে সাফ করে খেয়ে রেখেছে কেউ। পড়ে থাকা কয়েকটি ভাতের মতো চিরকেলে একাকী তারারা থিরথির করে কেঁপে যায় অবিরত। নদী থেকে একটা পাতলা কুয়াশা ওঠে সেই সময়। মাথার অনেকটা ওপরে দু তিনটে বাদুড় সমানে পাক খেয়ে যাচ্ছে। অথচ নদীর জলে নীচে শুয়ে থাকা পলি বড় স্পষ্ট দেখা যায়। সমুদ্রের জলের মতো অতলতা এর নাই। তবু কাজল বড় আশা করে থাকে। তার মনে হয়, এই, এই মাত্র, ওই দূরতম হারিয়ে যাওয়া কোণটি থেকে একটি সাইরেনের গান হয়তো শোনা যাবে। তারপর ধীরে ধীরে ওই অগভীর কালো জলের ভিতর থেকে একটি উলঙ্গ নারী মূর্তি ঘনিয়ে উঠবে। আঁশে তার যোনি দেখা যায় না! অথচ মুখের জায়গাটা অন্ধকার জমিয়ে পাকাতে গেলে শুধু মাত্র কাবেরীর আদলটাই ফুটে ওঠে! ব্যাঙ্গমীদের দেখলে এত কাম জাগে কেন তার? নিজেকে করা প্রশ্ন মাথায় বুকে ফোঁপরা খাঁচায় ধাক্কা খেয়ে খেয়ে খালি হাতে ফিরলে সে দূরে তাকিয়ে থাকে। যেখানটা অস্পষ্ট। কাছের জলে স্পষ্টতা তাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে এবং দিতে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এর মধ্যে নিজের গ্লাসে মাল গড়িয়ে নিতে নিতে শান্তনু বলে ওঠে, “এই না থাকা নিয়ে একটা চমৎকার ঘটনা হয়েছিল আমদের ওখানে জানিস। তাই ব্যাপারটা খানিকটা আঁচ করতে পারছি কী বলছিস!” কাজলের ভাবনায় ছেদ পড়লে সে বিরক্ত হয় এবং আবার ভাবতে বসে যে তার মানে শান্তনু এতক্ষণ সেই ‘চমৎকার’ ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করছিল! তা না হলে এত দেরী করে জবাব সে দেয় কেন? মনে রেখে উল্টে দিয়েছে এতই ‘চমৎকার’ ঘটনা বাল! তবু মুখে বলে, “কোন ঘটনা?” শান্তনু আলতো করে একটা চুমুক দিয়ে মুখ টুখ কুঁচকে ফেলে বলে, “আরে তোকে বলা হয় নাই! সে বহুদিন আগেকার ঘটনা!” এই গৌরচন্দ্রিকার পর যে ঘটনাটি শান্তনু বলতে শুরু করবে তা আদতে হিন্দুস্তান কেবলসের ঘটনা। সেও ভূতের গপ্পো। পাঠক মনে রাখবেন ভূতের গপ্পের বাজার কিন্তু গরম কচুরি। পাতে পড়তেও পায় না। এককালীন এশিয়ার বৃহত্তম কেবল ফ্যাক্টরি। শেষ দিকে কংগ্রেস আমলে যাও বা ধুঁকে ধুঁকে চলছিল বিজেপি ক্ষমতায় এসেই সর্বাগ্রে এটির টুঁটি ছিঁড়ে খুন করে এবং লাশটা শোপিস হিসেবে সাজিয়ে রেখে দেয়। এখন দেয়াল ভেঙে গ্রিল, ইঁট লোহা লক্কড় চুরি হয়ে আগাছা বেড়ে উঠেছে শহরের সেই পচা গলা লাশের উপর। খুনটা যে খুব বেশিদিন হয় নাই সেটা এখনও পূতিগন্ধে প্রকট! কয়েক হাজার বেকার বাপ মায়েদের ময়লা সাদা পাজরের হাড় ও টুকরা টাকরা পোকায় কাটা রঙ-চশমার ওপর শহরের গলিত অবয়ব টুকু আছে ঠিকই, তবু সেই থাকার পরতে পরতে না থাকার ঐতিহ্য বাসা বেঁধে থাকে শহুরে ভূতের মতো। রাতে সে আগলহীন ঘরের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে যেতে পথিক দেখতে পায় আলো জ্বলছে। হয়তো সঙ্গমের ঘর। মরা শহর রাতের অন্ধকারে শীৎকার দিয়ে ওঠে না। অথবা কোনও অশরীরীর কাণ্ড! যাইহোক তা পথিকের রহস্যময় মৃদু হাসি টুকু শুধু বুকে বয়ে ফেরে। পরিষ্কার হয় না তাতে কিছু। শুধু আলোআঁধারি বাড়ে। তবে শান্তনু যে সময়ের কথা বলছে, তখন কেবলস-এর জমজমাট অবস্থা। গ্রামকে গ্রাম সাঁওতাল কেটে কুচিয়ে তাদের তীর ধনুককে ব্র্যাণ্ড লোগো করে চিত্তরঞ্জন থানা গেড়ে বসেছে বেশ কিছু দিন আগে। তাতে কেবলস্ পত্তনের সুবিধেই হয়েছে। বন্যা টন্যা হয় কিনা ইত্যাদি জরিপ করে নিয়েছে তারা। সেই কেবলস্-এর ব্যাচেলর হস্টেলের পাশে একখান ছোট্ট কলোনি মার্কেট। তাতে সাত আটটা দোকান। মুদি, দর্জি, সেলুন, ময়রা, মায় একখান আইসক্রিম ফ্যাক্টরি পর্যন্ত রয়েছে। সেই মার্কেটের উপকণ্ঠ ধরে ইংরেজি পি আকৃতির যে কলোনি, তার নাম পি-টাইপ। মুখে মুখে হস্টেল কলোনি। হস্টেল মার্কেট থেকে রাস্তা ধরে সোজা পাড়ার বড় জলট্যাঙ্কির দিকে হেঁটে এলে একদিকে আলোকধারা মণিমালা, সেখানে প্রতিদিন বিকেলে ‘দাদাভাই’, ‘দিদিভাই’য়েরা ছোটদের খেলায়, শাসন করে, 'নীতিবোধ' শেখায়। সবাই বেশ টুকটুকে ফুটফুটে। শাদা ইউনিফর্ম ছাড়া মণিমালায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। রাস্তার উল্টোদিকে এক সারি ব্লক। প্রতি ব্লকে চারটে করে কোয়ার্টার ওপর নীচে। ব্লকের সারি এবং মণিমালা, দুটোরই পিছন দিকে জাম, বেল, কাঁঠাল প্রভৃতি কোম্পানীর প্ল্যান করে লাগানো বিরাট বড় বড় সব গাছ ক্রমশ ঝাঁকড়া হয়ে জঙ্গল হয়ে উঠেছে। এই ব্লকেরই একটায় তখন শান্তনুরা থাকে। আর তার ঠিক পাশের ব্লকে থাকে বিজিৎ। শান্তনুর খেলার বন্ধু। একই বয়েসী প্রায়। ওদের কোয়ার্টারটার একটু বদনাম ছিল। শোনা যেত, রাতের বেলা ওই বাড়ির ভেঙে ভেঙে আসা বহু পুরোন প্যারাপিটের ওপর সাদা শাড়ি পরা এক মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়! সেই কবে কোন কালে এক বিধবা নাকি আত্মহত্যা করেছিল! তার নাম ধাম মায় ঘটনাটা পর্যন্ত লোকে ভুলে গিয়েছে। কিন্তু আকারটা ভুলতে পারে নাই! বলা ভালো, ভুলতে দেয় নাই সে। বিজিৎ-রা অবিশ্যি বলত, ওরা কোনোদিনই দেখে নাই। অথচ কলোনির অনেকেই দেখেছে! সে কোথাত্থেকে আসে, কোথায় যায়, সেই অধি-জাগতিক অন্ধকার আকাশে তার খোঁজ কেউ পায় নাই কোনদিন। কিন্তু সে যে আসত, শান্তনু সেটা টের পেয়ে ছিল। কিন্তু চালু কথাবার্তার সঙ্গে তার মিল নাই। সময়টা প্রাগবর্ষা। গরমের প্রচণ্ড তাপ কিছুটা কমেছে। এর মধ্যে এক দুদিন হালকা ছিঁটে ফোঁটা ঝড় জল হয়ে গিয়েছে। রাতের আকাশ বহুদূর জুড়ে নিজেকে মেলে দিয়েছে পরিষ্কার। জ্বরের রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দরজার শীতল হাওয়া ঘাম ঘাম বুকে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে যায় যে স্পষ্টতায়, তেমনই। সেদিন বিজিতের জন্মদিন। ছাদের ওপর শতরঞ্জি পেতে বেশ খানিকটা হইচইয়ের পর লুচি, মাংস আর পায়েস এসে পৌঁছল। শহর সভ্য হতে শুরু করলেও বিজিতের বাবা ছিলেন খাঁটি গেঁয়ো লোক। তাই তাদের বাড়িতে তখনও কেক কাটা জাতীয় নিয়ম কানুন পৌঁছায় নাই! ঘিয়ে ভাজা লুচি, ঘুগনি, মাংস, পায়েস- এই ছিল জন্মদিনের প্রধান অতিথি! সবাই সার দিয়ে খেতে বসেছে। ছাদের পিছন দিকটায় চারটে কোয়ার্টারের জন্য দুটো সিমেন্টের জল ট্যাঙ্কি। বড় জল ট্যাঙ্কি থেকে দিনে দু বেলা জল ছাড়া হত। বাসিন্দারা বাথরুমের চৌবাচ্চায়, বালতিতে, এবং এই ছাদের ট্যাঙ্কিতে জল ভরে রাখতেন। ওভার ফ্লো হয়ে গেলে নীচে জলের ভাল্ভ বন্ধ করে দেয়া হত। তা সেই জলট্যাঙ্কির কাছে দাঁড়িয়ে বিজিৎ আর শান্তনু পরের দিন সাইকেল নিয়ে নতুন রাস্তা খুঁজতে বেরোবার প্ল্যান করছে। বিভিন্ন লোকালয়ের মধ্যে গিয়ে নানা রাস্তা খুঁজে বেড়ানো তাদের দুজনের সব থেকে প্রিয় খেলা সেইসময়। এতে করে রাস্তার গলি ঘুঁচি আর ফলের গাছ গুলো সব চেনা হয়ে যেত। তাড়া খেলে পালানোও সহজ। দু এক পরিচিত থাকলে তো কথাই নাই। নেতাজী কলোনির দিকে উদ্বাস্তু ক্যাম্প। ঐদিকে প্রচুর সবজি টবজি চাষ হয়। দু একটা শসা ছিঁড়ে চিবুতে মন্দ লাগে না। কিন্তু খানকির বেটারা টাঙি নিয়ে তাড়া করে মাঝে মধ্যে। ডবকা মেয়েছেলেগুলো ওখানে এমন জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় ওদের জায়গাটা ছেড়ে আসতে মন চায় না। বিজিতের বাপ গেঁয়ো, কিন্তু সে বড় হয়েছে কোয়ার্টারেই। কাজেই এ সবের সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় থাকলেও চোখ সয় নাই এখনও। নানান ফন্দিফিকির ওর মাথা থেকেই বেরোয়। প্রতিদিন নতুন নতুন আবিষ্কারের শখে দুই বান্দা তখন ফুটছে টগবগ করে। তারই আলোচনা চলছে। শান্তনু ব্লকের সামনের দিকের প্যারাপিটটা পিছনে রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। টুকটাক দু একটা হালকা কথা বার্তা হয়েছে কি হয় নাই, শান্তনুর একটা অস্বস্তি শুরু হলো। কেউ যেন দেখছে! ঘাড় বরাবর যেন তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে! কে রে বাবা? পিছন ফিরে সবার আগে ছাদের মেঝেয় বসা লোকজনকে পরখ করে শান্তনু। নাহ্‌! দেখছে না তো কেউ! এদিক ওদিক তাকিয়ে শিরশিরে অনুভূতির তুলনায় একটু হতাশই হয় সে। কিন্তু অস্বস্তিটা পিছু ছাড়ছে না কেন? আরো কিছুক্ষণ এদিক ওদিক লক্ষ্য করে সে যখন দৃষ্টি বিজিৎ-এর দিকে ফিরতে যাচ্ছে হঠাৎ মেঝের একটা কোনায় চোখ আটকে যায় তার। দু সারিতে লাইন করে বসে যারা খাচ্ছিল, তাদের শেষজনের ঘাড়ের ওপর দিয়ে প্যারাপিট আর ছাদের ঢালাইয়ের সংযোগস্থলটা দেখা যায়। একটা পিলারের মতো জায়গাটা একটু ছাদের দিকে ঢুকে এসেছে ছাদের মেঝের ওপর। রাস্তামুখো প্যারাপিটটার মাঝামাঝি। সেখানে কিছু নাই যতদূর স্পষ্ট দৃষ্টি যায়। কিন্তু স্পষ্ট দৃষ্টির সীমারেখার বাইরে অস্পষ্ট দৃষ্টির গোলকে প্যারাপিটের ঠিক ওপরটা থেকে কিছু একটার ছায়া পড়ছে অত্যন্ত আবছা। অস্পষ্ট। তাই জিনিসটা কী বোঝা যায় না! কিন্তু জিনিসটা যে হাওয়ায় কাঁপছে বোঝা যায়। কিছুক্ষণ ঐভাবেই নীচের শূন্য জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে শান্তনু! চোখ তোলার সাহস হয় না! বুকের স্পন্দন রগে টের পায় সে। তার সমস্ত বোধ বুদ্ধি যেন জমে বরফ হয়ে তার শিরদাঁড়া ঘেষে নেমে যেতে থাকে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ! ঘড়ির কাঁটা আটকে গিয়েছে! সময়টা যেন পেরোতেই চায় না! কোথাও একটা আটকে থাকার অসহায় বোধ আসে। দম বন্ধ। ঘাম ফুটে ওঠে ওর কপালে বিন্দু বিন্দু। শান্তনু মরিয়া হয়ে ওঠে চোখ তোলার জন্য। এমন সময় পাশ থেকে বিজিতের অস্ফুট একটা চিৎকারে ঘোরটা কেটে যায়। ঝট করে এক ধাক্কায় মুখটা তুলে ফেলে শান্তনু। প্যারাপিটের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে। বোঝা যায় মেয়েটি এতক্ষণ রাস্তার দিকে ঘুরেই দাঁড়িয়ে ছিল। শান্তনুর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার মুহূর্তেই এইদিকে তাকিয়েছে! তবে সে ঠিক দাঁড়িয়ে নাই, বলা যায় ভেসে রয়েছে প্যারাপিট ছুঁয়ে একরকম। কারণ তার পা দেখা যায় না। আর হাওয়াতে তার প্যারাপিটের সংলগ্ন শাড়ি এমন ভাবে উড়ছে, যা ভেতরে পায়ের শক্ত কাঠামো থাকলে ওড়া সম্ভব নয়। তবে মেয়েটির শাড়ির রঙ চোখ ঝলসানো লাল। সে সাঁওতাল। তার চেহারায় মাদকতা রয়েছে। একটা আলগা ইশারা মনে হতে থাকে শান্তনুর। কালো মুখ ছাড়িয়ে, মেয়েটির শরীর ছাড়িয়ে যেন আরও কিছু রয়েছে…প্রেক্ষাপট নয়…আরো অস্পষ্ট কিছু…ঠিক বুঝে ওঠা যায় না…হঠাৎ কারখানার লম্বা ভোঁ বেজে ওঠে… অপরিচিত মেয়েটি সামনে হালকা ঝুঁকে এদিকে কোণাকুণি তাকিয়ে থাকে এক মুহূর্ত, যেন শান্তনুরই অপেক্ষায়। শান্তনুর মেয়েটিকে দেখা সেই ভিক্ষা পাওয়া একটি মুহূর্ত। করুণ অথচ অতিলৌকিক সৌন্দর্যটির মুহূর্তেই সব শুরু, সব শেষ। মেয়েটির ছোট্ট মাথা হঠাৎ গড়িয়ে যায় পিছন দিকে। থাকে শুধু চাপড়া চাপড়া মাংসের দলার ফাঁকে উঁকি দিতে থাকা মেরুদণ্ডের গোলাপি গুটি…তাকে ঘিরে নিটোল বাকি শরীরটুকু। গুটানো মশারির উল্টো তালে মাথাকাটা মেয়েটির পিঠ থেকে বেরিয়ে আসে দুটি ডানা! জাল জাল চিকনের মতো জ্যোৎস্নার আলো ছিটকানো ডানা তার ঝাপট মারতে থাকে। এইটাও সাদা নয়, ঝিলমিলে রঙ বাহারি। তবে তা থেকে যে আভা ঠেলে বেরোচ্ছে তা সাদাটে। শান্তনুর মুখে সেই পিটুলি গোলা আলো পড়ে মুখটা করোটির মতো দেখায়। শান্তনু সেই মুহূর্তে বুঝতে পারে ও আর বেশিদিন বাঁচবে না। মেয়েটি ডানার ভারে বাতাস কাটতে কাটতে ক্রমশ উপরে উঠে যায় এবং উঠতে উঠতে এবং উঠতে মিশে যায় সেই স্ফটিক স্বচ্ছ আকাশের অসীমে। সে যে ছিল, সেই অতি-প্রাকৃতিক প্রমাণ যেন গাপ করতে চায় প্রকৃতি নিতান্ত হিংসুটির মতো।
শান্তনু বলে, “শুধু আমি নই, বিজিৎ-ও দেখেছিল জানিস! ও অবিশ্যি মুখ দেখতে পায় নাই। আমি ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি না দেখে ও নাকি তখন বেশ হতাশ! কোইন্সিডেন্টালি এদিকে ওর নজর পড়ে যায়, বুঝলি! তার আগে পর্যন্ত মহিলা রাস্তার দিকে ঝুঁকে কিছু দেখছিল। হয়তো জন্মের স্মৃতি, হয়তো মৃত্যুর! প্রথম যৌনতারও হতে পারে! কিছু বুঝে নাই কেউ! আর রইল বাকি আমার কথা, এখন মনে হয় আসলে আমি কিছুই দেখি নাই! না দেখায় আক্ষেপ হয় খুব! এক মুহূর্তে কীই বা দেখা হয় বল! অথচ স্পষ্ট যে দেখেছি তাও মনে আছে। ভদ্রঘরের নয়, অথচ সেই মুখ এই পৃথিবীর সৌন্দর্যও যে নয়, হতে পারে না, এই বোধটুকু ছিল, আছে, থেকে গেছে। অথচ যার মুখ মনে নেই তাকে নিয়ে অনুভূতি কেন? উল্টে পাল্টে যখন সেই ঘটনাটা স্মৃতির মধ্যে দেখতে যাই, বুঝলি, তার পায়ের নিচে কয়েক টুকরো পোড়া ইটের প্রায় ভেঙে আসা প্যারাপিটটা ছাড়া আর কিছুই পাই না আজকাল! কোনদিন পেতাম কিনা তাও মনে নাই! কিন্তু সে যে নাই, এইটাই বার বার তার থাকাটাকে কুঁদে কুঁদে ফুটিয়ে তোলে। সেই শেষ। তারপরে আর তাকে আমাদের পাড়ায় কেউ দেখে নাই! স্কুল আমি গিয়ে উঠতে পারি নাই, অনেক বার যাব ভেবেছি। তোর মতো অমন অনুভূতিও আমার নাই, তবু না থাকার অস্তিত্ব আমিও যেন খানিকটা ছুঁতে পারি ভাই!” কাজল অবাক হয়, “এও শালা উড়ে গিয়েছিল? কাবেরীও ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিল জানিস! তবে একদিনে আকাশে মিলিয়ে যায় নাই! বহুদিন ধরে ওর গমন পথের দিকে আমি তাকালেই ওকে দেখতে পেতাম। দিগন্তের এক ধারে সে এক ডুবে যাওয়া দৃশ্য! ডানার শব্দ শুনতে পেতাম। ক্রমশ সেই আওয়াজ তার আকারের মতোই ঝরে যাতে লাগলো। তারপর একদিন সব নিভে গেল টুপ করে। আমরা কেন উড়তে পারি না বলতে পারিস?” শান্তনু মদের বোতলের তলানিটা এক চুমুকে শেষ করে বলে, “তা কী করে বলি! এক একজনের একেকটা পাওনা জোটে বলতে পারিস। ধর এই যে নদী, এতো আমাদের পড়ে পাওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া—অথচ চরম ব্যক্তিগত পাওনা! এ জিনিস কজনের আছে বলতো?” সেই পাতলা কুয়াশার মধ্যে আবছা ঘোলা চোখ ভাসিয়ে কাজল বলে, “আমাদের সাপেক্ষে এ তো চিরন্তন! এত রাখতে পারি আমার ক্ষমতা কই? কিন্তু আমি অল্প চেয়েছিলাম বাঁড়া! ক্ষণিক চেয়েছিলাম! লোকে আমাকে ভুল ভেবে গেল! জানিস তো, মণীষার ডানা আমি এই জন্যেই কেটে নিয়েছিলাম। যাতে অন্তত একটা আধার আমার কাছে রয়ে যায়। কাটার সময় ঘ্যাঁসর ঘ্যাঁস করে আওয়াজ, মনীষার উত্তুঙ্গ চিৎকার, আর্তনাদ, আর আমার মুখে রক্ত, বুকে রক্ত, শিরদাঁড়ায় রক্ত! রক্ত! ঠোঁট চুঁইয়ে সে রক্ত উঠে আসছিল জিভে! ওফ! সেদিন যে কী সুখ পেয়েছিলাম শান্তনু! রক্তে সেই শিকলটা যত অনুভব করি, আমার এক অদ্ভুত রকমের স্বাধীনতার বোধ হয় জানিস! সারা জীবন তো কিছু পেলাম না! একে একে ভোরের কামিনী সব আশ্রয় সঙ্গে নিয়ে ঝরে গেল! একটা তো থাক! একজন তো থাক! না হয় নিজেকেই গলিয়ে ঢেলে রাখব প্রতিবার! তাতে ক্ষতিই বা কী- তখন এই ভাবছি আর কাটছি! আর কাটতে কাটতে অপার্থিব আনন্দ হচ্ছে, উল্লাস হচ্ছে। সেই আনন্দে আরো কাটছি শালা! চুতিয়ার ফাটা কপাল থেকে অন্তত একজনের উড়ে যাওয়া আটকাতে গিয়েছিলাম বিশ্বাস কর! অথচ মণীষাটা বাঁচল না! দুদিন ডানা কাটা অবস্থায় ছটফট করতে করতে আমার বিছানাতেই মরে গেল!” অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে শান্তনুর! কাজল চমকে ওঠে তাতে! ওর মনে হয় বাকি সবার মতন শান্তনুরও বোধহয় এই একটা জায়গাতেই কিছু অভিমান রয়েছে। কাজলের মতো জুয়েল ছেলে কেন খুন করবে? বন্ধু বান্ধবরা এই শকটা কেউ কাটিয়ে উঠতে পারে নাই! অথচ কাজল জানে সে জুয়েল ছেলে না। জুয়েল কাকে বলে? ভালো কাকে বলে? ছোটবেলা থেকে তাকে শেখানো হয়েছে অশিক্ষিতরা রুচিহীনরা ক্যাটকেটে রঙ পছন্দ করে—রক্তের রঙ তার এতখানি পছন্দ, সে কি আর ভালো হতে পারে? বরং ডানা কেটে ফেলার, নিজের শরীরে রক্ত মাখার আনন্দ সে জানে। গাঁড়ের গোড়ায় দু ইঞ্চি পুরু গু জমিয়ে রাখত যে কিরদার, সাদ্ কি তার মোহ জানতেন না? শঙ্করাচার্যকে ন্যাংটো করে তিনিই দেখিয়েছেন বলা যায়! যে খোলে, ভালো সে হতে পারে কখনও? কাজলও নিজের খুনের স্ক্রিপ্ট নিজেই নিজেকে দিয়ে লিখেছে। মাঝে পড়ে বালের ক্রেডিট নেওয়া কোনো দালাল ভগবানের অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না। একবার পাশের জঙ্গলে চড়ুইভাতি করার সময় এঁটো শালপাতা খেতে আসা কারো একটা ছাগলের ফুলে থাকা পেটে সে ভারি বুট দিয়ে এমন লাথি কষায় যে দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে নাক দিয়ে রক্ত টক্ত বেরিয়ে ছাগলটা বাচ্চাসমেত শেষ হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু কাটা শরীরের মতো ধড়ফড় করে নাই। চেঁচায় নাই। ছাগলটা লাথি খেয়ে চুপ করে একপাশে বসে ছিল। লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত যে বেরোয় নাই লক্ষ্য করেছিল কাজল। কয়েক মিনিট পরে বেরিয়ে ছিল। ছাগলটা কি ধীর স্থির ভাবে বসে সেই যন্ত্রণা, আসন্ন মৃত্যু কে উপভোগ করছিল? বেদান্তের শান্তি মনে করছিল? এ কথাটা বার বার তাড়া করে ফিরেছে ওকে! না হলে একটা ছাগলের মৃত্যু এমন কোনও ঘটনা না! এখন অবিশ্যি আর কিছুই মনে হয় না! তবে সে সময় ছাগলটাকে ধীরে ধীরে মরতে দেখে গোটা শরীর উল্লাসে মোচড় দিয়ে উঠেছে। বাঁড়ার মাথা অবধি রস এসে গিয়েছিল প্রায়! আহ্‌! কী আরাম! শান্তনুকে সে মনে মনে বলে মরাল মাড়াও তোমরা বাঁড়া? কেন? যৌনতা ব্যাথা নয়? মৃত্যু ব্যাথা নয়? জীবন ব্যাথা নয়? জন্ম ব্যাথা নয়? যন্ত্রণা দেয়া এবং নেয়ার মধ্যে যে স্বর্গীয় সুখ তার ছোঁয়া তোমরা নেবে ঠিক অথচ তার ওপরে ঝাঁপ ফেলে রাখবে! স্বীকার করার মেরুদণ্ড নাই! ক্লীব! থুঃ!!! কাজলের মুখ একটা পরিচিত রক্তচাপে লাল হতে থাকে। বিষয়টা ঠিক আর উপনিষদের ভাবনায় থাকে না। মাথা ঝিম ঝিম করে একটা হালকা সুর তৈরি করতে থাকে সেই পাতলা কুয়াশার ভিতর। অথচ সেই চরের একপাশ থেকে সেই সুর জমতে জমতে যখন এক মেটে গলার গান হয়ে ওঠে, তখন বোল গুলো শুনে কাজল একটু অবাক হয়! জলের স্রোতের একদম শেষ সীমানা থেকে ভেসে আসে আরেক মাতালের মিনতি- “জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই, কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই। ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি, কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ৷৷ কে খেলায়, আমি খেলি বা কেন, জাগিয়ে ঘুমাই কুহকে যেন। এ কেমন ঘোর, হবে নাকি ভোর, অধীর-অধীর যেমতি সমীর, অবিরাম গতি নিয়ত ধাই ৷৷ জানি না কেবা, এসেছি কোথায়, কেন বা এসেছি, কোথা নিয়ে যায়, যাই ভেসে ভেসে কত কত দেশে, চারিদিকে গোল ওঠে নানা রোল। কত আসে যায়, হাসে কাঁদে গায়, এই আছে আর তখনি নাই ৷৷ কি কাজে এসেছি কি কাজে গেল, কে জানে কেমন কি খেলা হল। প্রবাহের বারি, রহিতে কি পারি, যাই যাই কোথা কূল কি নাই? কর হে চেতন, কে আছ চেতন, কতদিনে আর ভাঙিবে স্বপন? কে আছ চেতন ঘুমাইও না আর, দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার। কর তমঃ নাশ, হও হে প্রকাশ, তোমা বিনা আর নাহিক উপায়, তব পদে তাই শরণ চাই ৷৷”
কাজলের মনে হয় ঠিক এই জন্যই বোধহয় যোগী আর স্যাডিস্ট ম্যাসোসিস্টদের মধ্যে এত মিল! জন্ম থেকে জন্মান্তরে মানুষ যন্ত্রণা ছাড়া আর কীসের চর্চা করেছে জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে? আত্মার উন্নতি? একটা ডাহা মিথ্যে কথা! যা অবিনশ্মর তার উন্নতি হয় না! হতে পারে না! সমস্ত জ্ঞানের চর্চাই যন্ত্রণা পাওয়া এবং নেয়ার কৌশল মাত্র! উত্তুরে হাওয়ায় সেই উদাত্ত গানের শব্দ কেটে কেটে ছত্রাখ্যান হয়ে বারবার ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত চরাচরে! না ওঠা চাঁদের স্মিত আলোর দেয়ালে ছিটতে থাকে যেন শীৎকার সহযোগে যোনি রস ও অনেকক্ষণ চেপে রাখা বুনো গন্ধের পেচ্ছাপ, এবং তা গড়িয়ে গড়িয়ে নামে অসংখ্য সুরে। সেই সুর নদীর স্রোতের মৃদু কল্লোলের মধ্যে আত্মবিলোপ করলে আরো সম্পূর্ণতা পায় গান। শুধু কাজলের ভাবনার স্রোত বুঝতে না পেরে শান্তনু বলে, “ভাবাটা উচিত হয় নাই, নদীকে স্বাধীন বলি বরং, আমাদের থাকা না থাকার সে পরোয়া করে না, চিরন্তন সে নয়, ডানাও ঠিক তাই। নেভা ও নিভানোর মতো পড়ে থাকি শুধু আমরাই বাঞ্চোৎ। আমরাই নিভে যাই এবং নিভিয়েও দেই। বার বার এঁটো মুখে ফিরে ফিরে আসি, গু গোবর চাটি কোয়ার্টারের! অদ্ভুত ব্যপার, সেই মুখটার কথা মনে পড়ছে আজ আমার খুব, জানিস! হয়তো কোয়ার্টারের ছাত সে ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলেই…” কাজল কিন্তু শান্তনুর চিন্তাখাত ধরতে পারে। বলে, “আমারও তাই অবস্থা! মনীষার মুখটাও আজ মনে করতে পারছি না! এক কাবেরী ছাড়া আজ যেন সব মিশে গিয়েছে আকাশে! কিন্তু ওদিকের বোধহয় সময় হল শান্তনু, চল উঠি!” একই বাইরের জগতে স্বতন্ত্র দুটি অন্দর মহল নিয়ে কাজল আর শান্তনু উঠে পড়ে। কালো সেই সমস্ত আকাশের অস্তিত্বটুকু জুড়ে কাজলের স্বত্ত্বা একীভূত তখন। কালো ঠিক নয়। বরং অন্ধকার। চাঁদোয়ার গভীরতা নিয়ে আকাশের এখানে ওখানে মৃতের মুখের ওপর চন্দনের দাগের মতো কেউ তারাদের ছড়িয়ে ছড়িয়ে এবং ছড়িয়ে রেখে যায়। এইসময়ে অজয়ের এক পাড়ের কাঁটাওয়ালা একটা নিঃসঙ্গ খেজুর গাছের ওপরে কেউ টাঙ্গিয়ে দেয় বহু বছরের পুরোনো একটা চাঁদ। হালকা কুয়াশায় আবছা একটা মাখো মাখো ঘষা স্বচ্ছতা তৈরী হয়। পলাশ, নারিকেলের সারি আর বড় বড় অর্জুন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় শ্মশানের আলো। একখানা চিতা জ্বলে যেতে থাকে একাকী। হেমন্তের রাত্রির উত্তুরে হাওয়ায় থির থির করে কেঁপে ওঠে তার গগনচুম্বী শিখা। ওপরে ঝুলে থাকা বিরাট একটা কড়ুই গাছের নীচের পাতাগুলো কারোর অশালীন প্রস্তাবে লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ। সেই লালিমাও আগুনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তারও ওপরে গাছের যে অস্তিত্ব তার নাগাল আর পাওয়া যায় না। সেখানে গাছ আর মহাকালের কালী মূর্তির বিমূর্ততা মিলে মিশে সীমারেখা মুছে গিয়েছে। ওরা সেই দিকেই এগোতে থাকে। “জ্বালিয়েছে, দেখছিস! সময় হয়ে এল প্রায়!” কাজলের কথার উত্তরে শান্তনু বলে, “হ্যাঁ! এই সেই আলো কাজল! দেখ! একটা জগৎ কেমন ভেঙে চুরে আরেকটায় মিশে যাচ্ছে! বলা ভালো উত্তীর্ণ হচ্ছে, না? ওফ! এর মধ্যে আবার আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছি কেন বল তো? আহা! পুরো না বুঝলি…তবে আভাসটুকু…”
এই আলো মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আসে, তাই হয়তো! এই আলোই আবার যখন গাঢ় অন্ধকারে মিশে যাবে তখন তোর 'তাকে', আমার কাবেরীকে, মণীষাকে সেই অস্তিত্ত্বহীনতার মধ্যে আরো পরিষ্কার দেখতে পাবো শান্তনু! জগতেরা তো মিশেই থাকে! এই তোর আমার মধ্যেই কত কত জগত এসে মিশেছে! বয়ে যাচ্ছে অজয়ের মতোই। তার কি আমরা হদিস রাখি? দুর্গাডিহির মতো কত সাঁওতাল গ্রাম জ্বালিয়ে এসে আমরা রেল ইঞ্জিন ফলাতে শিখলাম…ধীরে ধীরে সেখানেও ভূতের ছোঁয়া লাগল…মোহনপুর এই 'উন্নতি'-র দু ছটাক দূরত্বে থেকে লম্ফের কালিঝুলি মেখেই রইল…এই সব জগৎ এককা আরেকটা সঙ্গে মিশে রয়েছে…কিন্তু হদিস পায় কে? সে হদিস পাওয়ার জন্য এক একটা চিতার আগুন লাগে, নদী লাগে, এমন হেমন্তের গভীর যোনির মতো দিগন্ত লাগে! তবে তার হদিস পাওয়া যায়! আসলে আমার কী মনে হয় জানিস! চিতার থেকে বড় উদাহরণ জীবনের আর কিছু হয় না। ভাঙার এমন একটা এজেন্সি… এই অপার্থিব আলো, আগুন, পোড়া গন্ধের ধিকি ধিকি ছড়িয়ে যাওয়া, শব্দ করে চামড়ার ফেটে যাওয়া, হঠাৎ হঠাৎ উঠে বসা লাশ, তার অন্ত্রে পায়াখানা পুড়ে যাওয়ার গন্ধ, অনন্ত রূপান্তরধর্মী শুয়ে থাকা এবং প্রকৃতির বুকে মিশে যাওয়ায় নতুন জীবনে উত্তরণ! এর বাইরে কী আছে জীবনে বল তো! আমি বলি যে মরে নাই, মরে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা যে ভোগ করে নাই, তার সমস্ত ঝুলি খালিই রয়ে গেল! এই সমস্ত কিছু জানতে গেলে, উপভোগ করতে গেলে আগে মরে যেতে হবে ভাই, বার বার মরে যেতে হবে! মরার সামর্থও পেরিয়ে যেতে হবে…বিয়ন্ড বিয়ন্ড অ্যান্ড বিয়ন্ড…
সেই জ্বলতে থাকা শূন্য মহাকালের বুকে নদীর স্রোত ঠেলে কোনো এক অনিশ্চয়তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে দুই প্রাণের বন্ধু…ভূত তাদের সমস্ত অস্তিত্ব ছুঁয়ে রয়েছে…এই জগতের মিশমিশালি ক্ষেত্রে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকজন এসে যোগ দেবে তাদের সঙ্গে… যার দেহ ক্রমশ জ্বলে যাচ্ছে অই, অই ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে যাওয়া চিতার উষ্ণ বুকে…

No comments:

ফেসবুক কমেন্ট

অধিক পঠিত লেখাগুলি