‘কষ্টিপাথর’ কবে প্রথম বেরিয়েছিল? জানা নেই। আমার ঘরের পাশে, দশ কিমি দূরের একটা কাগজ, কিন্তু হাতে বোধয় এসেছিল কলেজ পড়ার সময়। যদিও নাম শুনেছিলাম তারও আগে কিন্তু কোথাও কোনো দোকানে তো পাওয়া যেত না (বেশিরভাগ লিটিল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেই এটা আমরা দেখতে পাই), আর কুণ্ঠাবশত চাওয়াও হত না। তার দু’এক বছর পরে পত্রপত্রিকায় টুকটাক লিখতে শুরু করলে, 'হেমলক'-এ (ওটাও আমার বাড়ি দেওগাঁও থেকে অনতিদূরে রাঙ্গালিবাজনা গ্রাম থেকেই বেরত) লিখলে, 'ইবলিশ' বেরলে তখন সরাসরি আলাপ হলে পর প্রথম 'কষ্টিপাথর' পাই হাতে। এসব বোধয় দু’হাজার দশ-বারো সালের ঘটনা। ততদিনে কয়েকটা সংখ্যা বেরিয়ে গেছিল 'কষ্টিপাথরে'র। হাতে এখন যে সংখ্যাটা নিয়ে বসে সেটা 'কষ্টিপাথরে'র পঞ্চম বর্ষ শারদ সংখ্যা। প্রকাশের সাল উল্লেখ নেই, মনেহয় ওই দু’হাজার দশের এদিক-ওদিকেই বেরিয়েছিল এ সংখ্যা। তার পরেও ক’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল অবশ্য। এখনও কি বেরয়? খবর পাই না। পত্রিকায় ধরন হিসাবে বলা এটি একটি ‘সমাজ মনস্ক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা’।
আমরা সূচি এবং বিষয়বস্তুতে চোখ বোলাই এবারে। সবার প্রথমে ‘বিশেষ রচনা’ বিভাগে তিনটি প্রবন্ধ। প্রথম প্রবন্ধ ‘গ্রন্থাগারের এখন’, লেখক বেণু সরকার। লেখক বলেন “দেশে মন্দির মসজিদ গির্জার চেয়ে এখন গ্রন্থাগার ও স্কুলকলেজের প্রয়োজন বেশি”, বলাবাহুল্য প্রবন্ধটি সে সময়ে দাঁড়িয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনিয়তার কথা বলে যা এখনও ভীষণই প্রাসঙ্গিক। অর্ণব সেন এর প্রবন্ধ ‘উত্তরের কথকতা। প্রবন্ধটিতে লেখক ইতিহাসে ‘উত্তরবঙ্গ’ নামের ব্যবহার, উত্তরবঙ্গের অতীতের পরিবর্তনশীল ভূগোল, জনবিন্যাসের হেরফের, ভাষাবৈচিত্র এসব দিক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। প্রসঙ্গত এই সময়কালে উত্তরের প্রায় সব লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতেই নিয়মিত অর্ণব সেনের প্রবন্ধ আমরা পেতাম। তার পরের প্রবন্ধ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনজাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিরলস গবেষণা করে চলা প্রমোদ নাথের। তাঁর প্রবন্ধটির নাম ‘মালপাহাড়িয়া জন গোষ্ঠীর বিবাহ রীতি’। আকারে ছোট হলেও এ সংখ্যার সম্পদ প্রবন্ধটি।
দ্বিতীয় অংশে কবিতা। উত্তম চৌধুরী, সুবীর সরকার, মানিক রায়, শমীক ষন্নিগ্রাহী, বিশ্বজিৎ বর্মন, মনোজ কুমার সিংহ, স্মৃতি দাস, কাজী গোলাম কিবরীয়া, শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাস, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণপদ কুণ্ডু, শশাঙ্ক শেখর পাল, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, মেহেবুব আরা পারভিন, অরূপ চন্দ, অমিত কাশ্যপ, ওয়াহিদার হোসেন এবং ফজলুল ইসলামের কবিতা সংখ্যাটিতে বর্তমান। তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী গোলাম কিবরীয়ার মতন কবিরা প্রয়াত হয়েছেন। সংখ্যাটির সব কবিতা সমান ভালো লাগেনি। দশ বছর আগের লেখার অনুরণন আজও কেউ কেউ আমরা করে চলেছি। যাই হোক ভালো লাগা কবিতা থেকে সব নয় দু’একটি অংশ উল্লেখ করি— “এই মস্করা/সারা জীবনের জন্য নয়
সময় চলতে থাকে/আমরা এগোতে থাকি/অথবা পিছিয়ে যাই এই আর কি
তবু/মস্করা করো
দেয়ালের ওপার থেকে মাথা দেখা যায়/আমি আরও একবার চমকে উঠি
হারমোনিয়ামে গান জেগে ওঠে/আর আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলি…” (মস্করা/ওয়াহিদার হোসেন)
“বৃত্তের মাঝেই ঘুরছে রাজপথ। হরতাল//বাংলা আকাদেমিতে উপচে পড়া ভিড়…/ধুর, শুধু বাংলাই ভালো” (সংস্কৃতি/ফজলুল ইসলাম)
"নুড়ি ও পাথর ঠেলে চলে যায় নদী—/নদীতে চপলতা ভাসে, ভাসে পাথরঠোকা মাছ/চিরকালীন শহরের পাশে পাশে নদী/বয়ে যায়" (এলিজি/সুবীর সরকার)
"… মৌসুম এখনও ছবি আঁকে/অনিমেষ এখনও কবিতায়/কেউ কেউ এখনও শোনে নীল রং ছিলো ভীষণ প্রিয়…" (দলছুট/শমীক ষন্নিগ্রাহী)
তৃতীয় অংশে গল্প। এ সংখ্যায় দেবাশিস চাকী, সমরজিৎ ভট্টাচার্য্য, সৌরেন চৌধুরী, তুষার চট্টোপাধ্যায় এই চার লেখকের চারটি গল্প। দেবাশিস চাকী ও সৌরেন চৌধুরীর গল্প দু’টি খুব একটা মনে ধরেনি। তুষার চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘ক’, শেষাংশটা সিনেম্যাটিক হলেও বিষয়বৈচিত্র আছে গল্পটিতে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সমরজিৎ ভট্টাচার্য্যের ‘উর্দ্ধতনের দিনলিপি’ গল্পটি। আঙ্গিকের দিক থেকে গল্পটির আলাদা বিশেষত্ব আছে। গল্পটিতে তিনটি চরিত্র, তিন চরিত্র নিয়ে তিনটি অংশ। শেষাংশে গিয়ে বোঝা যায় আগের দুই অংশ এবং তিন নং অংশ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। গল্পটির চলনে রহস্যরোমাঞ্চ থাকলেও এটি নিছকই রহস্য গল্প নয় বরং লেখার বিষয়বস্তুও ভীষণই প্রাসঙ্গিক, বাস্তবিক।
খুঁতখুতি: কিছু মুদ্রণপ্রমাদ আছে। শেষের তিন পৃষ্ঠা ব্যয় করা করা হয়েছে বিজ্ঞাপনের পেছনে।
পত্রিকা- কষ্টিপাথর, পঞ্চম বর্ষ, শারদ সংখ্যা
প্রকাশকাল- অনুল্লেখিত
ধরন- ছাপা/প্রিন্টেড
সম্পাদক- ফজলুল ইসলাম
প্রচ্ছদ- অভিজিৎ বর্মন
প্রকাশস্থান- রাঙ্গালিবাজনা, আলিপুরদুয়ার
মূল্য- ১০ টাকা মাত্র
যোগাযোগ- 9733132675
আলোচক: রাহেবুল
কৃতজ্ঞতা: ফেসবুক গ্রুপ ‘উত্তরবঙ্গের সাহিত্যসংস্কৃতি’ আর্কাইভ
1 comment:
অনেক অনেক ধন্যবাদ । খুশি হয়েছি ভাই ।
Post a Comment