চিত্র: ক্রিস্তোপাস আঙ্গুস
দিগন্ত অবধি বিস্তৃত এই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে: দেবজ্যোতি রায়
"মৃত্যু পূর্ণগর্ভ আর জীবন হল অনন্ত শূন্যতা", এরকমটাই তো জানিয়েছিলেন আমাদের উইলিয়াম ব্লেক তাঁর কবিতায়। মৃত্যু পূর্ণগর্ভ কিনা আমরা কেউ-ই জানি না,মরণের ওপার থেকে এসে কেউ জানায়নি আমাদের,কিন্তু নিজের জীবনের চারপাশে ও জীবনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ও ঘটতে থাকা কিছু ঘটনার স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে এরকমটাও ভাবতে ভাল লাগে,হয়ত বিশ্বাসও জন্মায় যে,যে সময়ের মধ্যে আমাদের যাবতীয় তারই কোনো ভাঁজের ওপারে বয়ে চলেছে আরেক সমান্তরাল জীবন,দেখি না,দেখা সম্ভব হয় না বলেই হয়ত ঝেড়ে কেশে উড়িয়ে দেই সেসব। তবে দুটো বিষয় নিজের জীবনের দিকে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়া থেকে নিজের কাছেই পরিষ্কার ও প্রমাণিত হয় যে ১) জীবন আজও তার অনেক রহস্য সমেত বহমান এবং ২) মৃত্যুর হাত ধরে সে হাঁটে অনন্তের দিকে। আমরা দাবা খেলি (আমরা বলতে জীবন)মৃত্যুর সঙ্গে,যে খেলায় না কেউ জেতে না হারে কোনো একজন। কিংবা যে পরাজিত সেও তো জয়ী এবং ভাইসি ভারসা। তবে এখানে আলোচ্য জীবন, মরণের এপারকে নিয়ে।
জীবনও কি দেখি? মৃত্যু যদি অন্ধকার হয় জীবন তো আলো। আমরা আসি অন্ধকার থেকে, ফিরে যাই অন্ধকারে। মাঝখানের এই জীবনটুকুই তো, তবু আশ্চর্য যে সেই জীবনরূপ আলোর মধ্যেও থাকে চাপ চাপ অন্ধকার আলো যেখানে পৌঁছায় না। ফলে জীবনের এক বিরাট রহস্যটা থাকে, জীবনের পথে না হাঁটলে যে রহস্যের তিল থেকে তাল কোনটারই নাগাল পায় না মানুষ। নিছক বেঁচে থাকাটাকেই তারা জীবন ভাবতে অভ্যস্ত হয়। আর এই বাঁচার সঙ্গেও সেকারণে লেপ্টে থাকে চাপ চাপ অন্ধকার, মৃত্যু।
কীভাবে বাঁচে মানুষ? যখন অন্ধকার রাতে পশ্চাতে রন্ধন নিয়ে উড়ে বেড়ায় জোনাকি, পুরুষ ঝিঁঝিপোকা পায়ে পা ঘষে মিলনের সঙ্কেত পাঠায় বহুদূর অন্ধকারে কোনো কান খাড়া করে অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী ঝিঁঝিপোকাকে, গলিত, স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে কোনো অজানার কাছে, তখন জীবনের মধ্যে যে উৎসব থাকে সেই গভীর উৎসবও আমাদের বোধে ধরা দেয়। মৃত মানুষকে যে দেখেনি জীবনের গভীর উৎসবের নাগাল সে পায় না— লিখেছিলেন জীবনানন্দ তাঁর ডায়েরিতে, গবেষক জানাচ্ছেন। মৃত্যুকে দেখাটাও তো মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলা করে জীবনের দিকে হেঁটে যাওয়া। কিন্তু মানুষ কি হেঁটেছে না হাঁটে জীবনের দিকে বেঁচে থাকাটাকেই যদি যে জীবন ভাবে? একটা বিভ্রম তৈরি হয় মাত্র।
আসলে প্রকৃতির শৃঙ্খলচক্র থেকে বেরিয়ে জীবনকেই তো ছুঁতে চেয়েছিল মানুষ যে জীবনের নাগাল সে পায়নি। গড়তে চেয়েছিল এক স্বয়ংক্রিয়, স্বতঃস্ফূর্ত মানব-সমাজ, মৃত্যুকে হারিয়ে নিজস্ব আলোতেই ভাস্বর হয়ে উঠতে চেয়েছিল, কিংবা চায়নি এসবকিছুই, প্রকৃতির মধ্যে যে জন্মান্ধতা, যে হিংসা ও দ্বেষ, তাকেই আরো নিখুঁত করে, আরো বাড়িয়ে তুলে, তারই উত্তরাধিকারে প্রকৃতির আলোকিত দিকসকলকে উপেক্ষা করে জগতের সকল কিছুতেই নিজের থাবা প্রসারিত করে নিজেকেই একমেবাদ্বিতীয়ম ভেবে নিজের জালেই বাঁধা পড়ে গেল সে। আর এই জালের ভেতর বেঁচে থাকাটাকেই সর্বৈব ভেবে হারিয়ে ফেলল জীবন, হারিয়ে ফেলল আলো, চাপ চাপ অন্ধকারে নিশ্ছিদ্র আশ্রয় তার তখন। ফাটা বাঁশের চিপায় পৃথিবীর সব রূপ রঙ রস মুছে যুথগত অভ্যাসে বন্দী সে। তাঁহার দাঁতের ফাঁকে আজন্ম তাঁহাদেরই মাংস। তাজা মাংস—খুনি ঠোঁট সর্বত্র লেহন করে তোকে।
মানুষের প্রতিটি আবিষ্কার যা থেকে সম্ভাবনা ছিল পৃথিবীকে নতুন করে গড়ে তুলবার ক্ষমতাগর্বী মানুষ সেসবই ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করে করে করে, নিজের আত্মাকে খুন করতে করতেই তার এ পথ চলা। প্রথমে সে নিজেকে খুন করে, পরে অন্যদের।
মদ আর হলুদ নাবিকের নোনাঝরা মেয়েমানুষের গান—এই বধ্যভূমিতে অমলিন থেক যেমন জহ্লাদ ফাঁসির দড়িতে থাকে কিংবা খুনি বুলেট যখন সে খুন হয়।
No comments:
Post a Comment