জিহ্বা-দণ্ড: জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
ভোরবেলা উঠে হাঁটা ভালো না সন্ধের অন্ধকার নামার আগে, এই নিয়ে দ্বিধা দেখতে পাই। ভোর রাতে রাস্তায় বেরিয়ে দেখেছি, পাড়ার পরিচিত কুকুরগুলোই প্রবল অসুবিধে হয়ে ওঠে। অন্য সময় দেখলে যারা বেশ চিনতে পারায়, তারাও নিরাপত্তাহীনতায় সব ক'টা দাঁত বের করে গোঁ গোঁ করে। আমারও ভয় হয়, সেই পরিচিত প্রাণীগুলোই কেমন অন্যরকম ব্যবহার করছে দেখে। অনেক ভেবে-চিনতে ভোরবেলায় বেরনোটা বাদ দিলাম। সন্ধের আগেই বেরোই হাঁটতে... তবে সিঁড়ির আলোটা না জ্বালা থাকলে, চাবিটা ঠিকঠাক তালায় ঢোকাতে অসুবিধে হয়। হ্যাণ্ড-আই কোঅর্ডিনেশন সহযোগিতা করে না। তা না করুক, অভ্যেস হয়ে যাবে, কিন্তু প্রতিদিন ওই বদলে যাওয়া ভীত-সন্ত্রস্ত মুখগুলোর বেরিয়ে থাকা দাঁতের প্যানিক-অ্যালার্ট তো সহ্য করতে হয় না! অন্য সময়ে বিস্কুট দিই, বান-রুটি দিই... ওদের ঢিল বা লাঠি নিয়ে তাড়া করা আমার দ্বারা হবে না। তার থেকে নিজেই রুটিন বদলে নিলাম।
মাঝে মাঝে নিজেকে দু'সারি দাঁতের পেছনে সুরক্ষিত জিভের মত মনে হয়। আড়ালে থাকা, বাঁচিয়ে থাকা, লুকিয়ে রাখা।
চোয়াল শক্ত রেখে, দাঁতে দাঁতে চেপে অপ্রিয় জায়গা আর অনুভূতিগুলো থেকে সরে যাই। নিজেকেই বাঁচিয়ে সরে যাই। জল কিংবা খাবার খেতে, অথবা নেহাৎ কথা বলার সময়ে যখন দাঁতের গেট খুলে যায়... জিভ দেখা যায়; জিভের সঙ্গে সঙ্গে আমিও বিপন্ন হয়ে পড়ি।
করপোরেশনের ধাতব কলের ওপর বসে থাকা কাকটা যখন মুখ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে... তাদের ঠোঁটের ফাঁকেও একই রকম বিপন্নতা দেখতে পাই। অক্ষমের ক্ষোভ। কেউ যার কানাকড়ি দাম দেয় না।
বাস স্ট্যান্ডের পেছন দিকে মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে থাকা সহনাগরিকদের অমোঘ বিপন্নতা দেখতে দেখতেই দুটো শিঙ্গারা আর একটা ছানার জিলিপী খেলাম। দোকানের দিকে মুখ করে, নিজেকে আড়াল করে... যাতে আমার মুখের হাঁ, উন্মুক্ত জিভ পথচলতি কেউ দেখতে না পায়। তারপর রঙ ফিকে হয়ে আসা প্লাস্টিকের জাগ থেকে ঢক ঢক করে চার ঢোক জল খেলাম। তাও দেওয়ালের দিকে মুখ করে। এদিকে আর টিউব-ওয়েলের জল পাওয়া যায় না। টাইম-কলের জল ফিল্টারে রেখে দেয়। বিস্বাদ লাগে এই জল। টিউব-ওয়েলের জলের সেই লোহা আর মাটির স্বাদ পাই না। খাবারের স্বাদও ধীরে ধীরে পালটেছে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো দোকান, তবে এবার সময় হয়ে এসেছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে প্রমোটারের কথা চলছে... ফ্ল্যাট হবে। দোকানের মালিককে প্রোমোটারের সঙ্গে বুঝে নিতে হবে। যে ক'টা দিন আছে... একটু ইচ্ছে মত খেয়ে নিই।
টাকা দেওয়া আর ফেরত পাওয়ার মাঝে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে মালিকের ভাইপোর কথাবার্তা শুনতে শুনতে জানলাম -- সব কাজ ভোটের জন্য থেমে আছে। এসব মিটলে আবার ধরা হবে। এরাও কাউনসিলর অবধি গেছে, নিজেদের হক ছাড়বে না।
সেই বয়স্ক লোকটি মিষ্টি কিনতে এসেছে মেয়ে-জামাইয়ের জন্য। জামাইয়ের ইলেকশন ডিউটি পড়েছে অন্য জেলায়। তাই ক'দিনের জন্য মেয়েকে বাপের বাড়িতে রেখে যাচ্ছে। এগুলোও জানা হল। লোকটা খুব মুখ চেনা লাগল।
দোকান থেকে বাস-স্ট্যান্ড আর তার লম্বা সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটা দেখা যায়। কোন বিধায়কের তহবিলের অনুদান থেকে নির্মিত, তা দেখা যায় না। কিন্তু আমি জানি -- কোন বিধায়ক, কোন রাজনৈতিক দলের নেতা। তার নাম করে ছেলেটাকে বললাম "ওঁর সঙ্গে কথা বলেছে সাধনদা?" দোকানের এখনকার মালিকের নাম সাধন। কিছুক্ষণ আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে, সেই ভাইপো বলল, "ধুর! সব ভোটের পরে। এখন কে শুনবে? মাথা খারাপ?!"
কিছুক্ষণ চুপ করে কেন ছিল... আমি জানি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে অনেকেই কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে, উত্তর দেয় না।
সেই বয়স্ক লোকটিকে আবার দেখলাম, দেওয়ালে আটকানো খবরের কাগজ পড়ছিল। আমরা একে অপরকে আগেও দেখেছি, হয়ত পরিচয় নেই। একটি বিশেষ বামপন্থী দলের সংবাদ-পত্র এই দেওয়ালে আটকানো থাকে। লোকটা আমার দিকে তাকাল না, চশমাটা বাঁহাতে ধরে খুব কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে পড়ছিল। অন্য হাতে নাইলনের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর বাজারের সবজি আর মিষ্টির প্যাকেট। হয়ত মাছ-মাংসও আছে। মেয়ে-জামাই এসেছে বলেছিল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল "মরার খবর ছাড়া আর কিছু থাকে না।" লোকটা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল 'কী?' আমি হেসে বললাম, "পাড়ার খবর আর কেউ রাখে না।"
- মানে?
- ওই, আগে পাড়ায় কারও কিছু হলে সবাই খবর পেয়ে যেত। এখন...
- ও... কিছু কি হয়েছে পাড়ায়?
- কিছু হয়েছে নাকি?
- ওই যে আপনি বললেন...
- আমিও তাই... খবরের কাগজ, পাড়ার খবর... সবই...
হাত নাড়িয়ে সব কিছু এদিক ওদিক উড়ে দিয়ে চলে গেলাম। লোকটা আমার দিকে দেখছিল। আমি আর পেছন ফিরে তাকালাম না। এতক্ষণে মনে পড়ল, লোকটা কেন মুখ চেনা লাগছিল। পার্টি করত। ভোটের সময় বসে থাকত টেবিলে, আর পাড়াতে মিটিং হলে টুপি পরে মাইকে হ্যালো হ্যালো করত। ওই মিষ্টির দোকানের পেছনের গলিটায় পার্টি অফিস ছিল তখন। ঘরটা এখনও আছে, তবে অন্য পার্টির... ক্যারম-বোর্ড, টিভি এনে ক্লাব ঘর হয়ে গেছে। অফিস না বলে ক্লাব বলা ভাল।
অনেক বছর পর দেখলাম লোকটাকে, এত দিন কেন দেখিনি... তাও বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল... কিন্তু আমি জানি উত্তর দেওয়ার আগে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেমন সবাই থাকে। আমার অস্বস্তি হয়।
অবশ্য পার্টির ছেলেদের উধাও হয়ে যাওয়া কোনও নতুন কথা না। মাঝে মাঝে অনেক দিন পর, অনেক বছর পর আবার দেখা যায়। কাউকে কাউকে আর দেখাই যায় না। একেবারেই না। অথবা... আছে কিন্তু নেই। থেকেও নেই।
অনেক সময়ে ছবির সামনে সিনিয়র নেতারা বলেন, "নেই... কিন্ত আছে। থাকবে।" তাদের কথা আলাদা।
সায়ক যখন কলেজে পড়ত, তখন গান গাইত -- ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...
তারপর কেউ কেউ গলা মেলাত। মেয়েরা গলা মেলাত। কোরাস। আমি গান গাইতে পারতাম না,সাইডে দাঁড়িয়ে থাকতাম। স্কুলেও গান গাইত সায়ক। এই গান দুটোই বেশি গাইত। পরে আরও গান তুলেছিল, "রেল লাইন পাতা হবে হেনরির হাতুড়ীর ঘায়ে ঘায়ে"... আরও কী সব। তারপর দেওয়াল লিখত, পোস্টার বানাত। মিছিলে হাঁটত। আমাকে ডাকত, যেতাম। সবসময়ে ইচ্ছে হত না... মাঝে মাঝে বেকার লাগত... নিজেকে। মেয়েরা কেউ সাইডে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দেখত না। আর আমি হাত মুঠো করে স্লোগান দিতে পারতাম না।
একদিন দেখলাম সায়ক আর কিছুই করছে না। মানে, একদিন... সায়ককে আর দেখতেই পেলাম না। অন্য কেউ গাইছে, অন্যরা দেওয়াল লিখছে... মিছিলের কথা বাদই দিলাম না হয়।
কিন্তু সায়ক তখন বেঁচেই ছিল, অন্য কোথাও। অনেক বছর পর যখন আবার দেখলাম - এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে... টাক ঢাকতে টুপি পরে থাকে। চোখ দুটো কোটরে ঢোকা, আর তুবড়নো গাল। চোখ দুটো দেখে মনে হল কিছু একটার নেশা করে, কীসের নেশা আন্দাজ করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করতে শুধু হাসল। জানলাম ওরা অন্য এরিয়ায় থাকে এখন। চাকরি পায়নি বলে টেনশনে আছে।
সায়ক আর পার্টির কাজ করত না। জমি-বাড়ির দালালী করত। গানও আর গাইত না বোধহয়। অন্ততঃ আমি আর ওকে গাইতে শুনিনি।
পার্টি অফিসটাও ঠেলা খেতে খেতে পাড়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে গেছে। দশ বছর আগে যারা পার্টির পতাকা লাগাত, তিন-চার বছর হল তারা অনেকেই অন্য একটা পার্টির পতাকা লাগাচ্ছে। এবছর দেখলাম একজনকে আর একটা দলের পোস্টার সাঁটাচ্ছে।
সায়ক শুধু একটা দলের হয়েই কাজ করত... যত দিন করতে দেখেছি। দালালীটা কতজনের হয়ে করত জানি না। দালালী একজনের হয়ে করা যায় না। লোকশান।
সেই বয়স্ক লোকটাকে দেখেই মনে পড়ে গেল সায়কের কথা। এর সঙ্গে সায়ককে অনেকবার কথা বলতে দেখেছি। এ এবং এর মতই আর কিছু লোকজনের কথা মত চলত সায়করা। ভাবলাম ফিরে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করি সায়ককে মনে পড়ে কি না... পার্টির কাগজে সায়কের খবর বেরিয়েছিল কি না।
মনে মনে রিহার্সাল করে নিলাম কী কী বলব। হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে গেল। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করল একসঙ্গে। কিন্তু গিয়ে আর লোকটাকে দেখতে পেলাম না। উলটোদিকের দোকানের সিঁড়িতে তিনটে ছেলে বসে ছিল। পাড়ায় কিছু হলে কেউ না কেউ ঠিক ওই সিঁড়ির ধাপে বসে থাকে। সিঁড়িগুলো গ্যালারি। পুজোর বিসর্জন, মিছিল, বডি নিয়ে যাওয়া, ফাংশান... যাই হোক, গ্যালারিতে বসে কিছু লোক অপেক্ষা করে, কখন সামনে দিয়ে যাবে। কিছুদিন আগে ঝড়ের জন্যেও বসে অপেক্ষা করেছে সারা সন্ধে। হালকা হাওয়া থেকে জোরে হাওয়া, জোরে হাওয়া থেকে ঝড় -- গ্যালারিতে বসে মজা দেখে মানুষ। নিজের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সব কিছুই বেশ মজার।
এখন যারা বসেছিল, তিনজনেই মুখ চেনা। জিজ্ঞেস করলাম "বুড়োটা কোথায় গেল রে?" ছেলেগুলো কোনও উত্তর দেওয়ার আগে চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ আমার দিকে। তারপর একজন বলল, "কোন বুড়ো?"
- ওই যে, একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে কাগজ পড়ছিল। হাতে ব্যাগ।
- ওহ... বিনুদা?
সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বলল, "বুড়োটা বলছিস কেন? বয়স্ক মানুষকে সম্মান দিতে শিখিস নি?"
আমি দু'পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, "ঠিকই তো... তা বয়স্ক মানুষটি কোন দিকে গেলেন ভাইটি?"
"জানি না!" বলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে দিল ছেলেগুলো। আমার দিকে তাকাবে না, এটাই আসল ইচ্ছে... বা অনিচ্ছে।
মনে মনে যা রিহার্সাল করেছিলাম, সব ভুলে গেলাম। ছেলেগুলোকে বুঝিয়ে দিলাম যে আমিও ওদের আর দেখছি না। আবার ফিরে গেলাম, ঠিক যেই পথে এগোচ্ছিলাম কিছুক্ষণ আগে। হারমোনিয়াম সারানোর দোকানটার সামনে এসে লোকটাকে আবার দেখতে পেলাম। সেই পার্টির ছাপ আঁকা টুপি পরা বিনুদা... এখন বুড়ো হয়েছে, টুপিটা নেই। হারমোনিয়াম সারানোর দোকানে নয়, দোকানটা বন্ধ... উলটো দিকের পাঁঠার-মাংসের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তখন ব্যাগে মাংস ছিল না... এখন কিনবে। বিনুদাকে দেখে আবার সায়কের কথা মনে পড়ে গেল। দু সপ্তাহ আগে এক স্কুলের বন্ধুর কাছে শুনলাম সায়ক হাসপাতালে, বাঁচার আশা নেই। লিভার সিরোসিস। অত্যাধিক মদ খাওয়ার ফল। কারও কথাই নাকি শুনত না। ক'দিন পর ফোন করে ছেলেটা জানাল -- মারা গেছে। আমার মা'কে এখনও দিইনি খবরটা। আমারই বয়সী ছিল সায়ক।
দেহ এল, দাহ হয়ে গেল... কেউ গান গাইল না। কেউ না। সেই মেয়েগুলোরও তো সব এতদিনে বিয়ে-থা হয়ে গেছে।
"বল বল বল বল না টুপিইইইই, কাকে পড়াই!"
- একী! একী!
"এখন কোন রঙের টুপি পরছ বিনুদা?"
- আপনি কে? তখন থেকে অভদ্রতা করে যাচ্ছেন!
" সায়ক কীভাবে শেষ হয়ে গেল, পার্টির সকলে জানে?
সায়ককে মনে পড়ছে বিনুদা? পড়ছে না? কী রে ঢ্যামনা... বল? পড়ছে না মনে?"
- একি... এসব কী হচ্ছে কী!
- এই রে... আজ আবার মাথা গরম হয়েছে... নিয়ে যা নিয়ে যা...
"শুধু তিন-ফসলা জমি নয়... অনেকেই ফেরেনি কাকু! ফিরবে না... শুধু তোরা খাসির কচি কচি হাড় চিবিয়ে যাবি!"
- দাঁড়িয়ে দেখছেন কী! দিনের বেলা মাতলামি করছে... এটা ভদ্রলোকের পাড়া!
- কী সার্কাস করছে তখন থেকে! হাটা মালটাকে।
"এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু... পিছন-পানে তাকাই যদি কভু...ক্ষমা করো...ক্ষমা করো... ক্ষমা করো প্রভু..."
- এই... অনেক হয়েছে... চল! বেরো বলছি!... বেরো!
ধাক্কা খেয়ে শিউরে উঠলাম!
নাহ... কেউ আমাকে ধাক্কা মারছে না... ওই হারমোনিয়াম সারানোর দোকানের সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম এতক্ষণ। সায়কের কথা আর গিয়ে বলা হয়ে উঠল না লোকটাকে। চলে গেছে দোকান থেকে।
মাংস কাটার সময়ে অনেকেই দোকানে দাঁড়াতে চায় না। মাংসের গন্ধে অথবা ছাগল কিংবা মুরগী মারা হচ্ছে... এইসবে রিপালশন অনুভব করে। আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না বেশিক্ষণ। তবে আমার অসুবিধেটা অন্য। ভারী ধারালো চপার দিয়ে যখন মাংস টুকরো করা হয়... কাঠের তক্তার ওপর প্রতিটা আঘাতের শব্দে মনে হয় চপারটা আমার জিভের ওপর পড়ছে। দু'টুকরো করে দিচ্ছে।
এই একই অসুবিধে হয়, যখন ডাবের জল কিনতে যাই। ডাব কাটতে দেখলেই মনে হয় কাটারির কোপ পড়ছে জিভের ওপর।
চোয়াল শক্ত করে, বন্ধ দাঁতের সারির পেছনে জিভকে সুরক্ষিত রেখে অপেক্ষা করি, কতক্ষণে এখান থেকে পালাবো।
আর এমনিতেও, আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চট করে কেউ উত্তর দিতে চায় না। আমারও অনেক সময় চট করে উত্তর দিতে অসুবিধে হয়। লাঠি-চার্জের পর একটা দিক অসাড় হয়ে গেছিল, অনেকদিন লেগেছিল ঠিক হ'তে। জিভটা ভারী লাগত কথা বলতে গেলে। তারপর থেকেই...
কিন্তু, এখনও সিঁড়ির আলো ছাড়াই অন্ধকারে চাবি দিয়ে গেটের তালা খুলতে পারি। আরও অনেক কিছু পারছি আসতে আসতে। এই যেমন বিনুদাকে দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল।
আবার, পারছি নাও অনেক কিছু। ভোরের আলো ফোটার আগে কুকুরগুলোর মুখোমুখি হ’তে কিছুতেই পারছি না।
সে আমার ব্যক্তিগত পারা, না-পারার ব্যাপার। সে আর শুনে কী হবে!
----------------
ভোরবেলা উঠে হাঁটা ভালো না সন্ধের অন্ধকার নামার আগে, এই নিয়ে দ্বিধা দেখতে পাই। ভোর রাতে রাস্তায় বেরিয়ে দেখেছি, পাড়ার পরিচিত কুকুরগুলোই প্রবল অসুবিধে হয়ে ওঠে। অন্য সময় দেখলে যারা বেশ চিনতে পারায়, তারাও নিরাপত্তাহীনতায় সব ক'টা দাঁত বের করে গোঁ গোঁ করে। আমারও ভয় হয়, সেই পরিচিত প্রাণীগুলোই কেমন অন্যরকম ব্যবহার করছে দেখে। অনেক ভেবে-চিনতে ভোরবেলায় বেরনোটা বাদ দিলাম। সন্ধের আগেই বেরোই হাঁটতে... তবে সিঁড়ির আলোটা না জ্বালা থাকলে, চাবিটা ঠিকঠাক তালায় ঢোকাতে অসুবিধে হয়। হ্যাণ্ড-আই কোঅর্ডিনেশন সহযোগিতা করে না। তা না করুক, অভ্যেস হয়ে যাবে, কিন্তু প্রতিদিন ওই বদলে যাওয়া ভীত-সন্ত্রস্ত মুখগুলোর বেরিয়ে থাকা দাঁতের প্যানিক-অ্যালার্ট তো সহ্য করতে হয় না! অন্য সময়ে বিস্কুট দিই, বান-রুটি দিই... ওদের ঢিল বা লাঠি নিয়ে তাড়া করা আমার দ্বারা হবে না। তার থেকে নিজেই রুটিন বদলে নিলাম।
মাঝে মাঝে নিজেকে দু'সারি দাঁতের পেছনে সুরক্ষিত জিভের মত মনে হয়। আড়ালে থাকা, বাঁচিয়ে থাকা, লুকিয়ে রাখা।
চোয়াল শক্ত রেখে, দাঁতে দাঁতে চেপে অপ্রিয় জায়গা আর অনুভূতিগুলো থেকে সরে যাই। নিজেকেই বাঁচিয়ে সরে যাই। জল কিংবা খাবার খেতে, অথবা নেহাৎ কথা বলার সময়ে যখন দাঁতের গেট খুলে যায়... জিভ দেখা যায়; জিভের সঙ্গে সঙ্গে আমিও বিপন্ন হয়ে পড়ি।
করপোরেশনের ধাতব কলের ওপর বসে থাকা কাকটা যখন মুখ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে... তাদের ঠোঁটের ফাঁকেও একই রকম বিপন্নতা দেখতে পাই। অক্ষমের ক্ষোভ। কেউ যার কানাকড়ি দাম দেয় না।
বাস স্ট্যান্ডের পেছন দিকে মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে থাকা সহনাগরিকদের অমোঘ বিপন্নতা দেখতে দেখতেই দুটো শিঙ্গারা আর একটা ছানার জিলিপী খেলাম। দোকানের দিকে মুখ করে, নিজেকে আড়াল করে... যাতে আমার মুখের হাঁ, উন্মুক্ত জিভ পথচলতি কেউ দেখতে না পায়। তারপর রঙ ফিকে হয়ে আসা প্লাস্টিকের জাগ থেকে ঢক ঢক করে চার ঢোক জল খেলাম। তাও দেওয়ালের দিকে মুখ করে। এদিকে আর টিউব-ওয়েলের জল পাওয়া যায় না। টাইম-কলের জল ফিল্টারে রেখে দেয়। বিস্বাদ লাগে এই জল। টিউব-ওয়েলের জলের সেই লোহা আর মাটির স্বাদ পাই না। খাবারের স্বাদও ধীরে ধীরে পালটেছে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো দোকান, তবে এবার সময় হয়ে এসেছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে প্রমোটারের কথা চলছে... ফ্ল্যাট হবে। দোকানের মালিককে প্রোমোটারের সঙ্গে বুঝে নিতে হবে। যে ক'টা দিন আছে... একটু ইচ্ছে মত খেয়ে নিই।
টাকা দেওয়া আর ফেরত পাওয়ার মাঝে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে মালিকের ভাইপোর কথাবার্তা শুনতে শুনতে জানলাম -- সব কাজ ভোটের জন্য থেমে আছে। এসব মিটলে আবার ধরা হবে। এরাও কাউনসিলর অবধি গেছে, নিজেদের হক ছাড়বে না।
সেই বয়স্ক লোকটি মিষ্টি কিনতে এসেছে মেয়ে-জামাইয়ের জন্য। জামাইয়ের ইলেকশন ডিউটি পড়েছে অন্য জেলায়। তাই ক'দিনের জন্য মেয়েকে বাপের বাড়িতে রেখে যাচ্ছে। এগুলোও জানা হল। লোকটা খুব মুখ চেনা লাগল।
দোকান থেকে বাস-স্ট্যান্ড আর তার লম্বা সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চটা দেখা যায়। কোন বিধায়কের তহবিলের অনুদান থেকে নির্মিত, তা দেখা যায় না। কিন্তু আমি জানি -- কোন বিধায়ক, কোন রাজনৈতিক দলের নেতা। তার নাম করে ছেলেটাকে বললাম "ওঁর সঙ্গে কথা বলেছে সাধনদা?" দোকানের এখনকার মালিকের নাম সাধন। কিছুক্ষণ আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে, সেই ভাইপো বলল, "ধুর! সব ভোটের পরে। এখন কে শুনবে? মাথা খারাপ?!"
কিছুক্ষণ চুপ করে কেন ছিল... আমি জানি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে অনেকেই কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে, উত্তর দেয় না।
সেই বয়স্ক লোকটিকে আবার দেখলাম, দেওয়ালে আটকানো খবরের কাগজ পড়ছিল। আমরা একে অপরকে আগেও দেখেছি, হয়ত পরিচয় নেই। একটি বিশেষ বামপন্থী দলের সংবাদ-পত্র এই দেওয়ালে আটকানো থাকে। লোকটা আমার দিকে তাকাল না, চশমাটা বাঁহাতে ধরে খুব কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে পড়ছিল। অন্য হাতে নাইলনের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর বাজারের সবজি আর মিষ্টির প্যাকেট। হয়ত মাছ-মাংসও আছে। মেয়ে-জামাই এসেছে বলেছিল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল "মরার খবর ছাড়া আর কিছু থাকে না।" লোকটা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল 'কী?' আমি হেসে বললাম, "পাড়ার খবর আর কেউ রাখে না।"
- মানে?
- ওই, আগে পাড়ায় কারও কিছু হলে সবাই খবর পেয়ে যেত। এখন...
- ও... কিছু কি হয়েছে পাড়ায়?
- কিছু হয়েছে নাকি?
- ওই যে আপনি বললেন...
- আমিও তাই... খবরের কাগজ, পাড়ার খবর... সবই...
হাত নাড়িয়ে সব কিছু এদিক ওদিক উড়ে দিয়ে চলে গেলাম। লোকটা আমার দিকে দেখছিল। আমি আর পেছন ফিরে তাকালাম না। এতক্ষণে মনে পড়ল, লোকটা কেন মুখ চেনা লাগছিল। পার্টি করত। ভোটের সময় বসে থাকত টেবিলে, আর পাড়াতে মিটিং হলে টুপি পরে মাইকে হ্যালো হ্যালো করত। ওই মিষ্টির দোকানের পেছনের গলিটায় পার্টি অফিস ছিল তখন। ঘরটা এখনও আছে, তবে অন্য পার্টির... ক্যারম-বোর্ড, টিভি এনে ক্লাব ঘর হয়ে গেছে। অফিস না বলে ক্লাব বলা ভাল।
অনেক বছর পর দেখলাম লোকটাকে, এত দিন কেন দেখিনি... তাও বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল... কিন্তু আমি জানি উত্তর দেওয়ার আগে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেমন সবাই থাকে। আমার অস্বস্তি হয়।
অবশ্য পার্টির ছেলেদের উধাও হয়ে যাওয়া কোনও নতুন কথা না। মাঝে মাঝে অনেক দিন পর, অনেক বছর পর আবার দেখা যায়। কাউকে কাউকে আর দেখাই যায় না। একেবারেই না। অথবা... আছে কিন্তু নেই। থেকেও নেই।
অনেক সময়ে ছবির সামনে সিনিয়র নেতারা বলেন, "নেই... কিন্ত আছে। থাকবে।" তাদের কথা আলাদা।
সায়ক যখন কলেজে পড়ত, তখন গান গাইত -- ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...
তারপর কেউ কেউ গলা মেলাত। মেয়েরা গলা মেলাত। কোরাস। আমি গান গাইতে পারতাম না,সাইডে দাঁড়িয়ে থাকতাম। স্কুলেও গান গাইত সায়ক। এই গান দুটোই বেশি গাইত। পরে আরও গান তুলেছিল, "রেল লাইন পাতা হবে হেনরির হাতুড়ীর ঘায়ে ঘায়ে"... আরও কী সব। তারপর দেওয়াল লিখত, পোস্টার বানাত। মিছিলে হাঁটত। আমাকে ডাকত, যেতাম। সবসময়ে ইচ্ছে হত না... মাঝে মাঝে বেকার লাগত... নিজেকে। মেয়েরা কেউ সাইডে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের দেখত না। আর আমি হাত মুঠো করে স্লোগান দিতে পারতাম না।
একদিন দেখলাম সায়ক আর কিছুই করছে না। মানে, একদিন... সায়ককে আর দেখতেই পেলাম না। অন্য কেউ গাইছে, অন্যরা দেওয়াল লিখছে... মিছিলের কথা বাদই দিলাম না হয়।
কিন্তু সায়ক তখন বেঁচেই ছিল, অন্য কোথাও। অনেক বছর পর যখন আবার দেখলাম - এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে... টাক ঢাকতে টুপি পরে থাকে। চোখ দুটো কোটরে ঢোকা, আর তুবড়নো গাল। চোখ দুটো দেখে মনে হল কিছু একটার নেশা করে, কীসের নেশা আন্দাজ করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করতে শুধু হাসল। জানলাম ওরা অন্য এরিয়ায় থাকে এখন। চাকরি পায়নি বলে টেনশনে আছে।
সায়ক আর পার্টির কাজ করত না। জমি-বাড়ির দালালী করত। গানও আর গাইত না বোধহয়। অন্ততঃ আমি আর ওকে গাইতে শুনিনি।
পার্টি অফিসটাও ঠেলা খেতে খেতে পাড়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে গেছে। দশ বছর আগে যারা পার্টির পতাকা লাগাত, তিন-চার বছর হল তারা অনেকেই অন্য একটা পার্টির পতাকা লাগাচ্ছে। এবছর দেখলাম একজনকে আর একটা দলের পোস্টার সাঁটাচ্ছে।
সায়ক শুধু একটা দলের হয়েই কাজ করত... যত দিন করতে দেখেছি। দালালীটা কতজনের হয়ে করত জানি না। দালালী একজনের হয়ে করা যায় না। লোকশান।
সেই বয়স্ক লোকটাকে দেখেই মনে পড়ে গেল সায়কের কথা। এর সঙ্গে সায়ককে অনেকবার কথা বলতে দেখেছি। এ এবং এর মতই আর কিছু লোকজনের কথা মত চলত সায়করা। ভাবলাম ফিরে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করি সায়ককে মনে পড়ে কি না... পার্টির কাগজে সায়কের খবর বেরিয়েছিল কি না।
মনে মনে রিহার্সাল করে নিলাম কী কী বলব। হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে গেল। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করল একসঙ্গে। কিন্তু গিয়ে আর লোকটাকে দেখতে পেলাম না। উলটোদিকের দোকানের সিঁড়িতে তিনটে ছেলে বসে ছিল। পাড়ায় কিছু হলে কেউ না কেউ ঠিক ওই সিঁড়ির ধাপে বসে থাকে। সিঁড়িগুলো গ্যালারি। পুজোর বিসর্জন, মিছিল, বডি নিয়ে যাওয়া, ফাংশান... যাই হোক, গ্যালারিতে বসে কিছু লোক অপেক্ষা করে, কখন সামনে দিয়ে যাবে। কিছুদিন আগে ঝড়ের জন্যেও বসে অপেক্ষা করেছে সারা সন্ধে। হালকা হাওয়া থেকে জোরে হাওয়া, জোরে হাওয়া থেকে ঝড় -- গ্যালারিতে বসে মজা দেখে মানুষ। নিজের ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত সব কিছুই বেশ মজার।
এখন যারা বসেছিল, তিনজনেই মুখ চেনা। জিজ্ঞেস করলাম "বুড়োটা কোথায় গেল রে?" ছেলেগুলো কোনও উত্তর দেওয়ার আগে চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ আমার দিকে। তারপর একজন বলল, "কোন বুড়ো?"
- ওই যে, একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে কাগজ পড়ছিল। হাতে ব্যাগ।
- ওহ... বিনুদা?
সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বলল, "বুড়োটা বলছিস কেন? বয়স্ক মানুষকে সম্মান দিতে শিখিস নি?"
আমি দু'পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, "ঠিকই তো... তা বয়স্ক মানুষটি কোন দিকে গেলেন ভাইটি?"
"জানি না!" বলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে দিল ছেলেগুলো। আমার দিকে তাকাবে না, এটাই আসল ইচ্ছে... বা অনিচ্ছে।
মনে মনে যা রিহার্সাল করেছিলাম, সব ভুলে গেলাম। ছেলেগুলোকে বুঝিয়ে দিলাম যে আমিও ওদের আর দেখছি না। আবার ফিরে গেলাম, ঠিক যেই পথে এগোচ্ছিলাম কিছুক্ষণ আগে। হারমোনিয়াম সারানোর দোকানটার সামনে এসে লোকটাকে আবার দেখতে পেলাম। সেই পার্টির ছাপ আঁকা টুপি পরা বিনুদা... এখন বুড়ো হয়েছে, টুপিটা নেই। হারমোনিয়াম সারানোর দোকানে নয়, দোকানটা বন্ধ... উলটো দিকের পাঁঠার-মাংসের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তখন ব্যাগে মাংস ছিল না... এখন কিনবে। বিনুদাকে দেখে আবার সায়কের কথা মনে পড়ে গেল। দু সপ্তাহ আগে এক স্কুলের বন্ধুর কাছে শুনলাম সায়ক হাসপাতালে, বাঁচার আশা নেই। লিভার সিরোসিস। অত্যাধিক মদ খাওয়ার ফল। কারও কথাই নাকি শুনত না। ক'দিন পর ফোন করে ছেলেটা জানাল -- মারা গেছে। আমার মা'কে এখনও দিইনি খবরটা। আমারই বয়সী ছিল সায়ক।
দেহ এল, দাহ হয়ে গেল... কেউ গান গাইল না। কেউ না। সেই মেয়েগুলোরও তো সব এতদিনে বিয়ে-থা হয়ে গেছে।
"বল বল বল বল না টুপিইইইই, কাকে পড়াই!"
- একী! একী!
"এখন কোন রঙের টুপি পরছ বিনুদা?"
- আপনি কে? তখন থেকে অভদ্রতা করে যাচ্ছেন!
" সায়ক কীভাবে শেষ হয়ে গেল, পার্টির সকলে জানে?
সায়ককে মনে পড়ছে বিনুদা? পড়ছে না? কী রে ঢ্যামনা... বল? পড়ছে না মনে?"
- একি... এসব কী হচ্ছে কী!
- এই রে... আজ আবার মাথা গরম হয়েছে... নিয়ে যা নিয়ে যা...
"শুধু তিন-ফসলা জমি নয়... অনেকেই ফেরেনি কাকু! ফিরবে না... শুধু তোরা খাসির কচি কচি হাড় চিবিয়ে যাবি!"
- দাঁড়িয়ে দেখছেন কী! দিনের বেলা মাতলামি করছে... এটা ভদ্রলোকের পাড়া!
- কী সার্কাস করছে তখন থেকে! হাটা মালটাকে।
"এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু... পিছন-পানে তাকাই যদি কভু...ক্ষমা করো...ক্ষমা করো... ক্ষমা করো প্রভু..."
- এই... অনেক হয়েছে... চল! বেরো বলছি!... বেরো!
ধাক্কা খেয়ে শিউরে উঠলাম!
নাহ... কেউ আমাকে ধাক্কা মারছে না... ওই হারমোনিয়াম সারানোর দোকানের সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম এতক্ষণ। সায়কের কথা আর গিয়ে বলা হয়ে উঠল না লোকটাকে। চলে গেছে দোকান থেকে।
মাংস কাটার সময়ে অনেকেই দোকানে দাঁড়াতে চায় না। মাংসের গন্ধে অথবা ছাগল কিংবা মুরগী মারা হচ্ছে... এইসবে রিপালশন অনুভব করে। আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না বেশিক্ষণ। তবে আমার অসুবিধেটা অন্য। ভারী ধারালো চপার দিয়ে যখন মাংস টুকরো করা হয়... কাঠের তক্তার ওপর প্রতিটা আঘাতের শব্দে মনে হয় চপারটা আমার জিভের ওপর পড়ছে। দু'টুকরো করে দিচ্ছে।
এই একই অসুবিধে হয়, যখন ডাবের জল কিনতে যাই। ডাব কাটতে দেখলেই মনে হয় কাটারির কোপ পড়ছে জিভের ওপর।
চোয়াল শক্ত করে, বন্ধ দাঁতের সারির পেছনে জিভকে সুরক্ষিত রেখে অপেক্ষা করি, কতক্ষণে এখান থেকে পালাবো।
আর এমনিতেও, আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চট করে কেউ উত্তর দিতে চায় না। আমারও অনেক সময় চট করে উত্তর দিতে অসুবিধে হয়। লাঠি-চার্জের পর একটা দিক অসাড় হয়ে গেছিল, অনেকদিন লেগেছিল ঠিক হ'তে। জিভটা ভারী লাগত কথা বলতে গেলে। তারপর থেকেই...
কিন্তু, এখনও সিঁড়ির আলো ছাড়াই অন্ধকারে চাবি দিয়ে গেটের তালা খুলতে পারি। আরও অনেক কিছু পারছি আসতে আসতে। এই যেমন বিনুদাকে দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল।
আবার, পারছি নাও অনেক কিছু। ভোরের আলো ফোটার আগে কুকুরগুলোর মুখোমুখি হ’তে কিছুতেই পারছি না।
সে আমার ব্যক্তিগত পারা, না-পারার ব্যাপার। সে আর শুনে কী হবে!
No comments:
Post a Comment