পড়া শেষ করলাম প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার ‘শাঙ্খিক’। কবিতায়, গদ্যে, গল্পে, অনুবাদে, ছবিতে পত্রিকাটি সমৃদ্ধ। বিভিন্ন চিত্রকর্ম দিয়ে অলংকৃতকরণের ব্যাপারটি আলাদা করে উল্লেখের দাবী রাখে। সঙ্গে যেটি আছে প্রথম দশকের কবি ও আঁকিয়েরা রবীন্দ্রনাথকে কী চোখে দেখেন এ নিয়ে একটা বিশেষ পর্ব।
অনবদ্য সম্পাদকীয়র পরে কবিতার প্রথম পর্বে বারীন ঘোষাল, প্রবীর রায়, স্বপন রায় এবং চৈতালী ধরিত্রীকন্যার কবিতা। বারীন ঘোষালকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটির প্রথম অংশ— “যেমন ইথার শব্দটাই আমরা জানতাম না/প্রাণ শব্দটা/ভালবাসা ঝুমকে আছে অমলতাসে/আর চমকে যাওয়া ঈশ্বর আমাদের শান্ত থাকতে দাও/যেমন ঈশ্বরের মানেই আমরা জানতাম না” ‘বাংলা কবিতার ভিলেন’ হয়তো মুচকি হাসছেন ওপাড়ে দাঁড়িয়ে। প্রবীর রায় ছোটো কবিতা লেখায় সিদ্ধহস্ত, এখানকার ৬ টি কবিতাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বপন রায় লেখেন— “তুমি যেভাবে হেসেছিলে/সে হাসি এখন ব্রিজ” গুমোট গরমে তরতাজা হাওয়ার মতন। চৈতালি ধরিত্রীকন্যা তাঁর কবিতা দু’টিতে তুলনামূলক অনেক খোলামেলাভাবে এ সময়ের নানান অভাব-অনটন, সমস্যা তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় পর্বে নীলম সামন্তের গদ্য ‘নদী আর পাখিদের কথা’। ভাবে আর ভাষায় লেখাটি উৎকৃষ্ট। পরবর্তী গদ্য শুভঙ্কর পালের ‘পঞ্চভূত ও আগুন’। ভালো লাগে কিন্তু বড্ড ছোট মনেহয়! এরপরেই এ সংখ্যার মূল আকর্ষণ ‘আমার চোখে রবিঠাকুর’। এ পর্বে মোট ১৪ জন কবি-শিল্পীর আঁকা এবং গদ্য। রাজীব দত্ত, গোপেশ দাস, রিন্টু কার্যী, শুভম কর্মকার ও চন্দ্রা সরকার, সৌমিক ঘোষের আঁকা এবং ছবির ওপরে করে লেখা কিছু কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনেহয়। চিত্রকর্মের স্বাদ পেতে চাইলে, উহাদের সঙ্গে পরিচয় সারতে হলে পত্রিকাটি পাঠ করতে হবে আপনাকেও পাঠক। এবার গদ্যের কথা বলি। প্রমিত পণ্ডিত, তন্ময় বসাকের গদ্য আরও বিস্তারে হলেও মন্দ হত না। প্রবীর মজুমদারের ‘আমার কবিতা রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত’। এ কথা বলতে সাহস চাই। কবি নিজের মতো যা বলেছেন, যে যুক্তি সাজিয়েছেন, ঘটনা হলো সেই ‘ভাবের রাজ্যে’ রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি কম জোরালো নয়, কবিতার আঙ্গিকে না মিললেও। অনিমেষ সরকারের গদ্য/প্রবন্ধ ‘প্রথম দশকের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব’। লেখাটিতে আরও বেশি করে এ সময়ের কবিতা ব্যবহার করলে, বিশ্লেষণ করলে প্রবন্ধটি একটি কাজের কাজ হত। কবি একাধিকবার রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের পরেই কেন ভাস্কর চক্রবর্তীর নাম নিচ্ছিলেন এবং সেখানেই কেন থামছিলেন? কবিতা তো সেখানে থেমে নেই, বরং পরবর্তী বিকল্পধারা/অপর কবিতা/নতুন কবিতা ইত্যাদি পেরিয়ে, শূন্যের কাজগুলি আমরা অতিক্রম করে এসেছি। শৌভিক বণিকের গদ্যটি তন্ময় বসাকের গদ্যটির যেন সম্প্রসারিত রূপ। ভালো লাগে। সুকান্ত দাস, সম্পাদক স্বয়ং একটি গদ্য লিখেছেন ‘চেস্টার বেনিংটন ও রবীন্দ্রনাথ’। প্রসঙ্গত বলি চেস্টার বেনিংটন হলেন ইংরেজি ভাষার র্যাপ-রক ব্যান্ড ‘লিন্কিন পার্ক’ এর মুখ্য গায়ক যিনি বছর দুয়েক আগে আত্মহননে শামিল হন। সেই চেস্টার বেনিংটন এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে জুড়ে একটি গদ্য রচনার ভাবনায় অভিনবত্ব আছে সন্দেহ নেই। শুভ্রদীপ রায়ের ‘দ্য লাস্ট মাইন্ড বেন্ডার’ তার ব্যক্তিগত জীবনে সেই শিশুকাল থেকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে হাসি-কান্নায় জড়িয়ে তা রস মাখিয়ে ভালোই বলেছেন। যেমন কবিতাপাঠ করতে গিয়ে ভ্যা-কান্নার অভিজ্ঞতাটা! দেবজিৎ বিশ্বাসের গদ্য ‘একথা ভিলেন: রবীন্দ্রনাথ’। পাঠকের সবচেয়ে বেশি হয়তো এ লেখাই ভালো লাগবে যদি তিনি হন আবার বাংলা সাহিত্যের পড়ুয়া! কারণ রবিদাদু যে কতভাবে মাথা হ্যাং করেছেন আমাদের মতন বাচ্চাকাচ্চাদের তার সুলুক দিয়েছেন কবি! হ্যাঁ অধমেরও একটি গদ্য আছে এতে, নাম ‘অর্বাচীনের ঠাকুর ভজনা’। সে নিয়ে বলবার ধ্যাষ্টামো না করি!
এতক্ষণ গদ্য পড়ে হাপিয়ে গেলে ফের ফিরবে কবিতার স্যালাড! দীপঙ্কর দেবনাথের ‘বনদেবতার দিনকাল’ কবিতাটা ভালো লাগে। কোট করার উপায় নেই কারণ পড়লে পুরো কবিতাটাই পড়তে হবে নইলে স্বাদ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তারপর আবু জাফর সৈকতের কবিতা। এরপর ওয়াহিদার হোসেনের কবিতা। প্রতিটা লাইনের পরে স্পেস লেখাটির ভাবোদ্ধারে অসুবিধা তৈরি করে। বিকাশ দাসের কবিতা দু’টি যথেষ্ট দীর্ঘ কবিতা, গ্রাম্যতাগুণে পুষ্ট। সত্তাপ্রিয় বর্মনের কবিতাটিতে ফন্ট পাল্টে গিয়েছে এক জায়গায়, চোখে লাগে। সেটা অবশ্য কবির দোষ নয়। আরও গাঢ় হোক তার কবিতা। রতন দাসের কবিতার নাম ‘অন্য জীবন’ হলেও কবিতার প্রথম অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গগুলি এ জীবনেরই এবং ব্যবহার হতে হতে সেকেলে। পঙ্কজ ঘোষের কবিতা ‘শহর সিরিজ’, বেশ লাগে। একাংশ পড়ি— “ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে/পারাপারে মানুষের ছায়াও হারায়/কী আশ্চর্য ঘুম নামে আমার শহরে!” রথীন্দ্রনাথ সাহার ‘মঞ্চ’ কবিতার শেষাংশটা সেকেলে মনে হলেও ‘ধর্ম’ কবিতাটি ভালো লাগে। অনন্যা দাশগুপ্তের দু’টি কবিতা, উচ্চারণে অকৃত্রিম সরলতা, একটির শেষ মাকে দিয়ে, আরেকটি শেষ বাবাকে দিয়ে!
এবারে দু’টি গল্প। দেবরাজ দে-এর লেখা অনেকদিন পরে পড়লাম। এ কি ‘মিথোজিবী’ সম্পাদনা করত সেই দেবরাজ? গল্পটির নাম ‘মহাজাগতিক’। এ সময়ের ক্রাইসিস লেখাটিতে ফুটে নয় ফেটেই উঠেছে। হায়রে ডি ভোটার, হায়রে এনআরসি, অমানবিক ক্রূর আমাদের রাজনীতি! আর বুদ্ধিজীবি সে কীসে লাগে? গল্পটি পাঠক পড়বেন, অবশ্য গা বাঁচিয়ে চলতে চাইলে উটপাখি হওয়াতেও দোষ দেখি না। অপর গল্পটি রুবাইয়া জেসমিনের ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’। বাপ-মা-সন্তান এসব নিয়েই মূল্যবোধ আর তার অবক্ষয়ের গল্প।
পত্রিকার শেষপর্বে রয়েছে একটি ধারাবাহিক অনুবাদ। দীপ হালদারের ‘Blood inland—An oral history of Marichjhapi massacre’ বইটির অনুবাদ। অনুবাদক সুশান্ত কর। একেবারে ঝরঝরে অনুবাদ। আর গদ্যটিও পাঠ করা ভীষণ জরুরি। উটকো ধর্মান্ধ দু’দল লোকের দাঙ্গার কবলে পড়ে সুখচাঁদ তার পরিবারকে নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে এ বাংলায় আশ্রয় নেন। আর একেকটা শরনার্থী শিবিরের দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে থাকেন। কীভাবে পাশের পাড়ার হিন্দুদের কাছেই এক গেলাস জল চাইতে হাসিঠাট্টা-অপমান সইতে হয়, কীভাবে শিবিরে সামান্য থিতু হতেই পাড়ি জমাতে হয় দণ্ডকারণ্যের দিকে …এভাবেই এগোছে বৃত্তান্ত।
সব মিলিয়ে বলতে পারি পত্রিকাটি পড়লে আশা করি সময় নষ্ট হবে না কারোরই। পত্রিকাটি উৎসর্গীত কিন্তু “হোয়াই দিস কোলাভেরি ডি বলা লোকগুলোকে”!
আলোচিত পত্রিকা: শাঙ্খিক মেটামরফোসিস পর্যায়, জুন-জুলাই ২০২০
ধরন- পিডিএফ
সম্পাদক: সুকান্ত দাস
প্রচ্ছদ: রিন্টু কার্যী
প্রকাশস্থান: কোচবিহার
মূল্য: বিনামূল্যে
যোগাযোগ: 7679449614
আলোচক: রাহেবুল
কৃতজ্ঞতা: ফেসবুক গ্রুপ ‘উত্তরবঙ্গের সাহিত্যসংস্কৃতি’ আর্কাইভ
No comments:
Post a Comment